২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ মাঘ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬
`

গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ফেরার আশা কাতারের

-

- আরো চার বন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস
- গাজায় হামাসের শক্ত অবস্থান অটুট
- দুই দিনে ১২০ গলিত লাশ উদ্ধার

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শেষ হলে সেখানের শাসন ক্ষমতায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) ফিরবে বলে নিজের আশার কথা ব্যক্ত করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন জাসিম আলে সানি। মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় রাখা বক্তব্যে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে ১৫ মাসের বেশি ধরে লাগাতার নির্মম আগ্রাসন চালিয়েও গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের অটুট অবস্থান খর্ব করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলি বিশ্লেষকরা। আলজাজিরা, রয়টার্স ও টিআরটি ওয়ার্ল্ড।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় আক্রমণ চালাতে থাকে ইসরাইল। ১৫ মাসের বেশি ধরে গাজায় ধ্বংসলীলা চালিয়েছে দখলদার সেনারা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৩৫ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার হিসেব তাদের কাছে আছে। আরো ১০ হাজারের মতো মানুষ নিখোঁজ রয়েছে যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। যুদ্ধবিরতির পর শতাধিক গলিত লাশ উদ্ধার থেকে তা প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরো এক লাখ ১১ হাজার ৯১ ফিলিস্তিনি। হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু।

দীর্ঘ ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী হামলা শেষে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় গাজায় তিন ধাপের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরাইল। গত রোববার এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কাতারের প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, গাজা কে শাসন করবেÑ সেটি ওই অঞ্চলের জনগণ ঠিক করবে, অন্য কোনো দেশ নয়। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, আমরা আশা করি পিএ গাজায় ফিরে আসবে। আমরা এমন একটি সরকার দেখতে চাই যা সত্যিই সেখানকার জনগণের সমস্যাগুলো সমাধান করবে। গাজাকে নিয়ে অনেক দূর যেতে হবে। যুদ্ধের পর গাজা কিভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়টি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সর্বশেষ চুক্তিতে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
যুদ্ধবিরতির চুক্তিটি কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সম্পন্ন হয় এবং এতে যুদ্ধবিরতি, ইসরাইলি বন্দীদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি এবং মানবিক সহায়তার প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গাজায় হামাসের যেকোনো ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল। যদিও যুদ্ধের আগে হামাসই গাজা শাসন করে এসেছে। এ ছাড়া গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকেও দেখতে নারাজ তেল আবিব।

হামাসের শক্ত অবস্থান অটুট : ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গাজায় ব্যাপকসংখ্যক হামাস যোদ্ধার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। তিন বন্দী নারীকে রেডক্রসের হাতে হস্তান্তরের সময় এই দৃশ্য ইসরাইলের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ১৫ মাস ধরে হামাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অভিযান চালানোর পরও হামাসের পুনরুত্থান ইসরাইলের ব্যর্থতার প্রমাণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইসরাইলি বিশ্লেষক আভি ইসাচারফ বলেছেন, ১৫ মাস যুদ্ধের পরও হামাস গাজায় তার অবস্থান শক্ত রেখেছে। নেতানিয়াহু সরকার হামাসকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়েছে। হামাস শুধু সামরিকভাবেই টিকে থাকেনি, বরং তাদের শাসন ও কর্তৃত্বও অক্ষত রয়েছে। নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পূর্ব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে নেতানিয়াহু সরকার হামাসের বিকল্প শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলেও তিনি দাবি করেন। ইসাচারফ হামাসের পুনরুত্থানকে ‘এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার জন্য কোনো যথাযথ পরিকল্পনা না নেয়াকে ‘অপরাধমূলক ও ইচ্ছাকৃত অবহেলা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইসরাইলের বেসরকারি সংস্থা ‘হাবিথোনিস্টিম’-এর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আভিভি বলেছেন, ইসরাইলি নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ শুধু হামাসের সামরিক শক্তি ধ্বংস এবং এর নেতাদের হত্যার দিকেই মনোনিবেশ করেছে। হামাসকে একটি শাসকগোষ্ঠী হিসেবে উৎখাতের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

হারেৎজ পত্রিকার সামরিক বিশ্লেষক আমোস হারেলও একই মত পোষণ করে বলেন, গাজা সিটির কেন্দ্রে শত শত সশস্ত্র হামাস কর্মীর উপস্থিতি তাদের শক্তির প্রমাণ। তিনি মনে করেন, নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কথার কথা মাত্র। বাস্তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে। হারেল বলেন, ইসরাইল এই যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছে। বন্দীদের ফিরিয়ে আনা এবং হামাসের সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছিলেন, শুধু সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হামাসকে পরাজিত করা যাবে না। হারেল মনে করেন, ইসরাইলের প্রতিটি সামরিক অভিযানের পর হামাস পুনর্গঠিত হয়ে মাঠে নেমেছে। এটি একটি চিরস্থায়ী যুদ্ধের রেসিপি।

আরো ৪ বন্দীর মুক্তি : গাজায় যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে হামাস আরো চার ইসরাইলি নারী বন্দীকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিনিময়ে ইসরাইল তাদের কারাগারে আটক আরো ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে। এর আগে শনিবার প্রথম ধাপে তিন ইসরাইলি বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে ইসরাইল ৯০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়। রয়টার্স জানায়, মুক্তি পাওয়া বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি বন্দী সম্প্রতি আটক হয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি ঘোষণা করা হয়নি। মঙ্গলবার হামাসের কর্মকর্তা তাহের আল নুনু জানান, যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে চার ইসরাইলি নারী বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। এই বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়ার আওতায় ছয় সপ্তাহের মধ্যে হামাস ৩৩ ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দেবে এবং ইসরাইল তাদের হাতে আটক কয়েক শ’ ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছাড়বে। চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে হামাসের হাতে থাকা বাকি ইসরাইলি বন্দীরা মুক্তি পাবেন এবং ইসরাইলি সেনা পুরোপুরি গাজা ছাড়বে। তৃতীয় ধাপে গাজার পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে, যা সম্পন্ন হতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। পাশাপাশি নিহত ইসরাইলি বন্দীদের লাশ ফেরত দেয়ার বিষয়েও আলোচনা চলছে।

১২০ গলিত লাশ উদ্ধার : গাজায় যুদ্ধবিরতির পর নিজ নিজ এলাকায় ছুটে যাওয়া গাজাবাসী ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনে স্বজনদের লাশ খুঁজছেন। রাফার ধ্বংসস্তূপের মাঝে লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা। তবে কঙ্কাল ছাড়া মিলছে না কিছুই। আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গাজায় ১৫ মাসের বেশি ধরে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এরই মধ্যে অবরুদ্ধ উপত্যকাটির লাইফলাইন খ্যাত রাফার ধ্বংসস্তূপের মাঝে লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা। যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে হারানো স্বজনদের খুঁজতে হতভাগ্য পরিবারের শতাধিক ফোন পেয়েছেন বলে জানান তারা। এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, দুই দিনে গাজায় ১২০টি গলিত লাশ উদ্ধার করেছি আমরা। কঙ্কাল ছাড়া আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই।

২৪০০ ত্রাণবাহী ট্রাক : এ দিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির পর এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৪০০টিরও বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে। জাতিসঙ্ঘের শীর্ষস্থানীয় ত্রাণবিষয়ক কর্মকর্তা মুহান্নাদ হাদি গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গতকাল বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে টিআরটি ওয়ার্ল্ড। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন উপত্যকাটিতে ছয় শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করার কথা রয়েছে। তবে গাজায় এই লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ট্রাক প্রবেশ করেছে। যার ফলে এখন পর্যন্ত উপত্যকাটিতে দুই হাজার ৪০০টিরও বেশি ট্রাক প্রবেশ করেছে। মুহান্নাদ হাদি বলেছেন, এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলার কোনো স্পষ্ট সমস্যা দেখা যায়নি। তিনি বলেন, গত তিন দিনে ছোটখাটো লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, তবে ‘আগের মতো নয়’।
জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তা বলেন, তবে এটি সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ নয়। খাবারের ঝুড়ি নেয়ার চেষ্টায় শিশুরা কিছু ট্রাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরো কিছু লোক ছিল (যারা) বোতলজাত পানি নেয়ার চেষ্টা করছিল। তিনি বলেন, ‘আশা করি কয়েক দিনের মধ্যে গাজার মানুষ বুঝতে পারবে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য থাকবে। তখন এসব দূর হয়ে যাবে।’


আরো সংবাদ



premium cement