২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ মাঘ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬
`
কুষ্টিয়ায় আনন্দ মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ

১৬৭ দিন পঙ্গু হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন মেজবাহুর

পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত মেজবাহুর রহমান : নয়া দিগন্ত -

৫ আগস্ট বেলা ৩টা। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে আনন্দে ফেটে পড়ে কুষ্টিয়ার ছাত্র-জনতা। সাথে সাথে বের হয় আনন্দ মিছিল। জিরো পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছিলেন তারা। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মেজবাহুর রহমান (৩২)। হঠাৎ মিছিলের ওপর শুরু হয় পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি। আনন্দ মিছিলে পুলিশের গুলির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। মিছিলকারীরা দিগি¦দিক ছুটলেও একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় মেজবার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। গুলিতে পায়ের হাড় কয়েক টুকরো হয়ে বেরিয়ে যায়। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। সেই লুটিয়ে পড়া মেজবাহ আজো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। ১৬৭টি দিন পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ১০টি রড (এলিজা) পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। নড়াচড়া করতে হলেও অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। অথচ দুই সন্তানের জনক এই মেজবাহ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
গতকাল রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় মেজবাহুর রহমানের সাথে। এ নম্বর ওয়ার্ডের ২২ নম্বর বেডে একাই শুয়ে আছেন তিনি। প্রথম দিকে পর্যায়ক্রমে স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনরা তার সাথে থাকতেন। কিন্তু প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস তার সাথে আর কে থাকবে? তাই একাই থাকতে হচ্ছে তাকে।
মেজবাহ জানান, তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের মজমপুর এলাকায়। কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানিতে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। একই সাথে ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাতেন। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান, ছোট ভাইবোন নিয়ে সংসার। স্বৈরাচার সরকারের সময় নানা ধরনের নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ওঠে তার পরিবার। এরই মধ্যে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। যেখানে ছাত্রদের পাশাপাশি যুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। মেজবাহও যুক্ত হন সেই আন্দোলনে।

তিনি বলেন, ৪ আগস্ট রাত থেকে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। তখনো পুলিশ রাবার বুলেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় পুলিশের সাথে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হন কয়েক শত। বিকেলে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার জনতা। আমরাও মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে এগোতে থাকি। ঠিক তখনই কুষ্টিয়া থানা থেকে পুলিশ রাইফেল, শর্টগান দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে বের হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মেজবাহ বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। তীব্র ব্যথায় যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখেন রাত। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের বারান্দায় অন্যদের সাথে পড়ে আছেন তিনি। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রাত ৯টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেসে দু’জনকে উঠিয়ে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশে। এর মধ্যে আবারো জ্ঞান হারান তিনি। পরদিন সকালে নিজেকে পঙ্গু হাসপাতালে দেখেন। এ পর্যন্ত ছয়বার অপারেশন হয়েছে তার পায়ে। কিন্তু এখনো পায়ের পাতায় কোনো অনুভূতি পান না। কনিষ্ঠ আঙুলে কিছুটা অনুভূতি থাকলেও পুরো পাতাই অনুভূতিহীন। গুলিতে ভাঙ্গা হাড় কেটে ফেলায় দুই ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেজবাহ বলেন, চাকরিটা চলে গেছে। থাকলেও ডিউটি করার সাধ্য ছিল না। চিকিৎসার জন্য এতদিনে অনেক টাকা ঋণ করে ফেলেছি। সংসার চালাতে আমার অটোরিকশা চালাচ্ছেন ৭০ বছর বয়সী বাবা। এই শীতে ঠিকমতো চালাতেও পারেন না। তারপরেও এতগুলো মানুষের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। ছয় ও চার বছর বয়সী ছেলেমেয়ে দুটো বাবার মুখ দেখতে পারে না। তাদের চিন্তায় আমি নিজেও ছটফট করি। কিন্তু কিছুই করার থাকে না।
চিকিৎসকেরা বলছেন, মেজবাহুর রহমানকে যে অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল তার থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন। তবে পায়ের রডগুলো খুলে হাসপাতাল থেকে কবে ছাড়া পাবেন তা এখনো বলা যাচ্ছে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement