২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ মাঘ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬
`
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বন্ধ, রাখাইনে ৬ লাখ রোহিঙ্গা অবরুদ্ধ

-

একদিকে মিয়ানমার জান্তা সরকারের নির্যাতন, নির্বিচারে গুলি আর বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ, অন্যদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে নিগৃহীত হয়ে যখন রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ছুটতে থাকে, সীমান্তে পৌঁছে রাষ্ট্রপরিচয়হীন এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ দেখে বাংলাদেশ তা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রভাবশালী ব্রিটিশ মিডিয়া গার্ডিয়ান রোহিঙ্গাদের আকুতিমাখা স্বীকারোক্তি নিয়ে প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘আমরা সব আশা হারিয়ে ফেলেছি।’ কারণ মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা মুসলিম শরণার্থীদের আটক করে বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষীরা ফিরিয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকানে তার বাড়ির আবছা আলোয়, মোহাম্মদ তার ছোট সন্তানের কান্নার আওয়াজের মধ্যে কথা বলছিলেন টেলিফোনে গার্ডিয়ানের প্রতিনিধির সাথে।
৩২ বছর বয়সী মোহাম্মদ জানান, তার তিন সন্তানই ক্ষুধার্ত, বাবা-মা, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, ভিডিওকলে মোহাম্মদ যখন কথা বলছেন তখন তাকে কেবল দৃশ্যমান দেখা গেছে।

মোহাম্মদ এখন রোহিঙ্গা মুসলিম পরিচয় দিতে তার নিরাপত্তার জন্য খুব বেশি ভয় পান- চার বছরের মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের পরে রাখাইন রাজ্য একটি বিপজ্জনক জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য। মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি, খাদ্যের অভাব, পরিষ্কার পানি একটি বিলাসিতা এবং আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতা থেকে আমার পরিবারকে রক্ষা করার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মাসে বাংলাদেশে আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর (সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেয়া) আমরা সব আশা হারিয়ে ফেলেছি।
গার্ডিয়ানকে রোহিঙ্গাকর্মী লুইন বলেন, এই ধরনের কর্মকাণ্ড নির্যাতিত গোষ্ঠীর সুরক্ষা অস্বীকারকে স্বাভাবিক করার ঝুঁকি তৈরি করে। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমান থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর পথ বাংলাদেশের নোংরা শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটি ২০১৭ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারি ৩৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আধাসামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আটক করে এবং জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। ১১ জানুয়ারি, মানবপাচারকারীদের সহায়তায় মিয়ানমার থেকে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করার সময় বিজিবি কমপক্ষে ৫৮ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তুলে নেয়। এই আটকের চার দিন পর, ৩০ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর একটি দলকে বাংলাদেশী পুলিশ ‘উদ্ধার’ করে। এই ব্যক্তিরা- যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন - তাদের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত।

স্থানীয় বাংলাদেশী পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবৈধ অনুপ্রবেশ’ রোধে একসাথে কাজ করার জন্য ‘নির্দেশ’ দেয়া হয়েছে। চার দশক আগে মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পর থেকে, রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন, ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই এবং আইনত সীমান্ত অতিক্রম করতে অক্ষম। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান নিশ্চিত করেছেন যে ১১ জানুয়ারি আটক ৫৮ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি বলেন, আমাদের নীতি হলো বিদেশী অবৈধ বাসিন্দাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া নয়। এটি মিয়ানমারের বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন যখন মনে হচ্ছে আরাকান সেনাবাহিনী রাখাইনের বেশির ভাগ অংশের কার্যত কর্তৃত্বে নিয়েছে, তখন তাদের প্রতি আমাদের বার্তা স্পষ্ট। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের প্রতিধ্বনি করে, আমরা তাদের আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে বলি। তিনি আরাকান আর্মিকে রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা এবং তাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য করতে পারে এমন যেকোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের বেশির ভাগ মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা- জাতিসঙ্ঘ গণহত্যামূলক সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে বলে জাতিসঙ্ঘ বলছে। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণের জন্য মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে লড়াই সে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদ্রোহীরা রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নিয়েছে। রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক, যাদের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ রাখাইনে রয়ে গেছে, তারা যুদ্ধের মধ্যে আটকা পড়েছে। তারা গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, ড্রোন হামলা এবং তাদেরকে জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নিয়োগের মুখোমুখি হয়েছে, একই সাথে তারা নিজেদের খাবার এবং আশ্রয়ের জন্য লড়াই করছে।

বাংলাদেশ সরকারের অনুমান অনুসারে, ২০২৩ সালের শেষের দিক থেকে কমপক্ষে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে পৌঁছেছে। অন্যান্য অনুমান অনুসারে এই সংখ্যা ৮০ হাজার পর্যন্ত। বাংলাদেশে বসবাসকারী একজন রোহিঙ্গাকর্মী লুইন বলেন, ৫৮ জন রোহিঙ্গাকে আটকে রাখার ফলে ‘মিয়ানমারে এখনো আটকে থাকা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের ঝড় উঠেছে। আমি এটিকে আমার জনগণের অনিশ্চিত অস্তিত্বের আরেকটি স্মারক হিসেবে দেখছি। এই ধরনের কর্মকাণ্ড নির্যাতিত গোষ্ঠীর সুরক্ষা অস্বীকার স্বাভাবিক করার ঝুঁকি তৈরি করে। এটি শরণার্থীদের অধিকার এবং সুরক্ষার প্রতি আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।
৩০ বছর বয়সী মোহাম্মদ শফিক গত জুনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি জানান, ২০২৪ সালের এপ্রিলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমাকে প্রথম আমার গ্রাম থেকে অপহরণ করে। তারা আমাকে সামান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য করে। এখন তিনি কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবিরে তার আত্মীয়ের আশ্রয়ে থাকেন। শফিককে যে সামরিক শিবিরে রাখা হয়েছিল, সেই সামরিক শিবিরটি আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে। শফিক বলেন, তারা আমাদের একটি তালাবদ্ধ ঘরে আটকে রাখে যেখানে কোনো বায়ুচলাচল ছিল না, আমাদের প্রতিদিন মারধর করা হতো। দুপুরে প্রতিদিন একবার খাবার সরবরাহ করা হতো। নির্যাতনের তীব্রতার কারণে আমার কিছু সঙ্গী মারা যান, অন্যরা লড়াই করেও বেঁচে যান। গত বছর ১৭ জুন, আরাকান আর্মির কর্মকর্তারা আমাদের অযতেœ রেখে যাওয়ার পর আমরা আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। আমি পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি।

আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন এখনো চলছে। বাংলাদেশের নতুন সরকারকে তা নিশ্চিত করা উচিত। তারা সে পুরনো শেখ হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি অনুসরণ করছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত শরণার্থীদের স্বাগত জানানো নিশ্চিত করা। তাদের নিবন্ধনের জন্য জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থার সাথে কাজ করা।
জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি নভেম্বরে সতর্ক করে দিয়েছিল যে রাখাইন দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কারণ যুদ্ধের ফলে কৃষিকাজ ও বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এই মাসে জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে যে মিয়ানমারে সঙ্ঘাতের কারণে ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গত শনিবারের সর্বশেষ রোহিঙ্গা আটকের সাথে সাথে, মিয়ানমারে এই জনগোষ্ঠীর মাঝে উদ্বেগ বেড়ে গেছে যে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রস্থান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রাখাইনে মানবেতর জীবনযাপন করা মোহাম্মদ বলেন, যখন আমি তাদের আটকের খবর শুনলাম, তখন আমার ভেতরে কিছুটা তৈরি হলো। আমরাও বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম সেখানে আমরা নিরাপদে থাকতে পারব। কিন্তু এই কথা শোনার পর, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এখানেই মারা যাওয়া ভালো হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে গণহত্যা থেকে পালাতে পারি? আশ্রয় চাওয়া কি অপরাধ? তিনি জিজ্ঞাসা করেন। মনে হচ্ছে পৃথিবী আমাদের পরিত্যাগ করেছে।


আরো সংবাদ



premium cement