সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবের নামে বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড়
অর্থের উৎস নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য- মনিরুল ইসলাম রোহান
- ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৫
সাবেক রেলমন্ত্রী মো: মুজিবুল হকের বিরুদ্ধে নামে বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ চার লাখ ৩২ হাজার ৮১০ টাকাসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাবের পরিমাণ সাড়ে চার কোটি টাকা দেখালেও প্রকৃতভাবে তিনি হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ গড়েছেন। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ ২০ হাজার টাকাসহ স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ মিলিয়ে এক কোটি টাকার হিসাব তিনি দেখিয়েছিলেন। রেলমন্ত্রী হওয়ার পরই মূলত মুজিবুল হকের ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘুরে যায় এবং একে একে তিনি অবৈধ পন্থায় এসব সম্পদ গড়ে তোলেন। হলফনামায় দেয়া তথ্যানুযায়ী, তার স্ত্রী হনুফা বেগমের নগদ ২০ লাখ টাকাসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। স্ত্রী হনুফা বেগমের সুবাধে শ্বশুরবাড়ির লোকজন সাদামাটা জীবনযাপনের খোলস থেকে বেরিয়ে আলিশান ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক হন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করেন বলে তার এক ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কমিশন বাণিজ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, পদোন্নতিসহ বিদেশে ব্যবসা, নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ব্যবসার মুনাফা, টেন্ডারের কমিশন, চাঁদাবাজির ভাগসহ নানা উপায়ে গত ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন সাবেক রেলমন্ত্রী মো: মুজিবুল হক। তার শাশুড়ির নামেও দেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটবাড়ি। তার স্ত্রীর অপর তিন বোন আগে সাদামাটা জীবনযাপন করলেও মুজিবুল হকের দেয়া অবৈধ অর্থে তারা এখন আলিশান বাসায় থাকেন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। শ্বশুরের পরিবারের সবাইকে বিলাসবহুল চলাচলের অর্থের জোগানদাতা সাবেক এই মন্ত্রী। লোকচক্ষুর আড়ালে মিষ্টির প্যাকেটে করে, মাছের ঝুড়িতে বহন করে লাখ লাখ টাকা নিকটাত্মীয়রা হনুফা বেগমের বাসায় গিয়ে হস্তান্তর করতেন। আর এসব কাজে সহায়তা করেন স্ত্রীর ভাগনে বিপ্লব, শ্যালক নাসির, শাহপরাণসহ আত্মীয়স্বজনরা। মুজিবুল হকের অবৈধ অর্থের ক্যাশিয়ার ছিলেন স্ত্রী হনুফা বেগম।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক এই মন্ত্রীর একটি ফ্ল্যাটবাড়ির বিছানায় বিপুল টাকা ছড়ানো ছিটানো সংবলিত একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। ছবিটিতে দেখা গেছে, মুজিবুল হকের তিন সন্তান বিছানায় বসে আছে। তাদের সামনে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে ৫০০ ও ১০০০ টাকা নোটের বেশ কয়েকটি বান্ডিল। ছবিতে আরো দেখা গেছে, এক সন্তানকে মুজিবুল তার কোলে নিচ্ছেন, আরেকটি শিশু একটি শপিং ব্যাগে থাকা সেই টাকার বান্ডিলগুলো নিয়ে খেলা করছে। আর দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য দেখছেন মুজিবুল হকের স্ত্রী হনুফা বেগম। ধারণা করা হচ্ছে- মুজিবুল হকের কোনো এক সন্তানের জন্মদিনে এই ছবি তোলা হয়েছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই রেলমন্ত্রী হন মো: মুজিবুল হক। মন্ত্রী হওয়ার পরই ভাগ্যের চাকার গতি ব্যাপক হারে ছুটে চলে। তখনই ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে (রোড-এ) ১১ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তিনি। যার আনুমানিক মূল্য ১২ কোটি টাকা। এই বাড়িটি শাশুড়ি জ্যোৎ¯œা বেগমের নামে ক্রয় করা হলেও করোনাকালীন মৃত্যুর আগে তিনি নাতি-নাতনিদের নামে লিখে দেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ৮ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৪ তলা বাড়ি নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। কুমিল্লার ঝাউতলায় ২৯৫ নম্বর বাড়িতে ২/৩টি ফ্ল্যাট, কালীগঞ্জ এলাকায় বাণিজ্যিক জায়গাতে কয়েকটি দোকান ক্রয় করা হয়। রাজধানীর কমলাপুরে বহুতল ভবন প্রথমে স্ত্রীর এক ভাগ্নের নামে ক্রয় করা হয়। এ ছাড়াও কুমিল্লার নিমসার কাবিলাতে স্ত্রীর দ্বিতীয় বোন শিরীন আক্তারকে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করে দেন সাবেক এই মন্ত্রী। চান্দিনার মিরাখলা শ্বশুরবাড়ির খুপরি বসতি তুলে দিয়ে রাজসিক বাড়ি নির্মাণ করে দেন তিনি। চান্দিনার মিরাখলাতে মন্ত্রী তার স্ত্রীর তৃতীয় বোনকে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করে দেন যারা দিন এনে দিন খেতেন। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, চান্দিনার বিলাসবহুল এলাকায় একটি কমপ্লেক্সে সাবেক এই মন্ত্রী তার স্ত্রীর চতুর্থ বোনকে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করে দেন। রাজধানীর ৬০ ফিট আগারগাঁওয়ে একটি বাড়ি ক্রয় করেন যেখানে মুজিবুল হকের স্ত্রীর বড় বোন বসবাস করছেন। বগুড়াতেও বিভিন্ন কমার্শিয়াল ভবনে তিনি দোকান ক্রয় করেন যার পরিচালনা করেন মন্ত্রীর ভাগ্নে বিপ্লব। অধিকাংশ সম্পত্তি মন্ত্রীর শাশুড়ি জ্যোৎসা বেগমের নামে ছিল, পরবর্তীতে তা সন্তানসহ অন্যদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়াও মুজিবুল হকের শ্যালক নাসির মুন্সী, শাহপরাণ মুন্সীসহ অন্যান্যদের নামে বেনামে সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। মুজিবুল হকের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা পরিচালনা করার অভিযোগও রয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করার জন্য নগদ ৭৬ লাখ টাকা তার আত্মীয় লুৎফর রহমান খোকনকে দেন মুজিবুল হক। যদিও এখনো খোকন ওই ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। যদিও ওই অর্থ লেনদেনের বিষয়টি তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে অস্বীকার করেন। খোকন একজন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। গতকাল তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার সাথে সাবেক রেলমন্ত্রীর কিছু ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আমি তখন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করতাম। সেই সুবাদে আমার মাধ্যমে তিনি মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে ৮ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি ভবন নির্মাণ করছিলেন। ওই ভবনটির চার তলা পর্যন্ত ছাদ উঠেছে। এখনো শেষ হয়নি। খোকন বলেন, ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটি উনার শাশুড়ির নামে ছিল। করোনার সময় তিনি মারা যান। এর আগেই মুজিবুল হকের সন্তানদের নামে তিনি লিখে দেন।
মন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা বেগমের ভাগ্নে বিপ্লবের কাছে এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইলে কল করলেও তিনি ধরেননি। সাবেক রেলমন্ত্রীর শ্যালক নাসির মুন্সীর ব্যক্তিগত ফোনে কল করলে বন্ধ পাওয়া গেছে। গত ৫ আগস্টের আগে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি আগে বিদেশ ছিলাম, এখন দেশে ব্যবসা করি। কিসের ব্যবসা করেন প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। এ ছাড়াও দু’টি ব্যক্তিগত গাড়ি পরিচালনা করেন- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমার দু’টি গাড়ি আছে। এগুলোর ব্যয়ভার কোথা থেকে আসে- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই লাইন কেটে দেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সাবেক এই মন্ত্রীকে গতকাল তার ব্যক্তিগত মোবাইলফোনে কল করলে বন্ধ পাওয়া গেছে। যদিও এসব অভিযোগের বিষয়ে গত ৫ আগস্টের বেশ আগে তিনি এ প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, এসব সম্পদ তার নামে নেই। তার নামে যা আছে তা হলফনামায় উল্লেখ করা আছে। এর বাইরে তার কোনো সম্পদ নেই।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতন ঘটার বিষয়টি বুঝতে পেরেই আগে ভাগেই অন্তরালে চলে যান সাবেক রেলমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো: মুজিবুল হক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই সপরিবারে তিনি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রেলওয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎপূর্বক নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা