সরকারি ৪ ব্যাংকে গণপদোন্নতিতে অর্থমন্ত্রণালয়ের অসন্তোষ
পদ ছাড়াই ৮ হাজার কর্মকর্তাকে গণপদোন্নতির ব্যাখ্যা চাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সরকারি চার ব্যাংকের পদ ছাড়া প্রায় ৮ হাজার কর্মকর্তাকে গণপদোন্নতি দেয়ায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই বিভাগের কোনো ধরনের সম্মতি ছাড়াই এ ধরনের পদোন্নতি বিধিবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই পরিস্থিতিতে আগামী ২২ জানুয়ারি বুধবারের মধ্যে পদোন্নতির কারণ ব্যাখ্যাসহ পদোন্নতির ফলে বছরভিত্তিক ব্যাংকের আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ উল্লেখ করে জানানোর জন্য সংশ্লিষ্ট চার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত ১৫ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে এ চিঠিটি পাঠানো হয়। রাষ্ট্রমালিকাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক শাখা-১ এর উপসচিব আফরোজা আক্তার রিবার স্বাক্ষর করা ‘পদ না থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে ৭ হাজার ২১৫ জনের পদোন্নতি’ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ শীর্ষক এই চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১৪ জানুয়ারি তারিখের পত্রিকায় ‘পদ না থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে ৭ হাজার ২১৫ জনের পদোন্নতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। উক্ত পদোন্নতির ফলে ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে মর্মে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া প্রকাশিত সংবাদে উক্ত পদোন্নতির ফলে বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ আর্থিক সংশ্লেষ তৈরি করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংক পিএলসি, জনতা ব্যাংক পিএলসি, অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি ও রূপালী ব্যাংক পিএলসি রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করার নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী পদোন্নতি প্রদানের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর শূন্য পদে জনবল নিয়োগ বা যেকোনো পদোন্নতির ক্ষেত্রে যথাযথ বিধিবিধান অনুসরণ করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়াও অপর এক নির্দেশনায় নিজ নিজ ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামো এর বাইরে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি প্রদানের সুযোগ নেই মর্মে অবহিত করা হয়। উক্ত নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে উল্লিখিত সাংগঠনিক কাঠামোতে পদ না থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে, যা প্রচলিত বিধিবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে, সাংগঠনিক কাঠামোতে পদ না থাকা সত্ত্বেও সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি প্রদানের কারণ ব্যাখ্যাসহ উক্ত পদোন্নতির ফলে বছরভিত্তিক ব্যাংকের আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ উল্লেখ করে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে ২০২৫ সালের ২২ তারিখের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে প্রায় ৮ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭ হাজার ২১৫ জনই পদোন্নতি পেয়েছেন সুপার নিউমারারি (পদ ছাড়াই পদায়ন) ভিত্তিতে। নজিরবিহীন এ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর অর্গানোগ্রাম বা জনবল কাঠামো ভঙ্গ করে। পদ না থাকলেও এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ইতিহাসে এর আগে কখনোই এভাবে গণপদোন্নতির ঘটনা ঘটেনি বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোয় এখন শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও), প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) ও সিনিয়র অফিসার (এসও) পদে। এর মধ্যে কেবল ১ হাজার ৬৭ জনকে এসপিও থেকে এজিএম বানানো হয়েছে। এজিএম হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী পদের প্রথম ধাপ। বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি এজিএম হওয়া প্রত্যেক কর্মকর্তা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণ পান। ক্রয়কৃত গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে পান ৪২ হাজার টাকা। এ ছাড়া এজিএমদের জন্য ব্যক্তিগত কক্ষও বরাদ্দ থাকে। পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কক্ষ ও চেয়ার-টেবিল দিতেই ব্যাংকগুলোকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর রেকর্ডসংখ্যক পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পেছনে এ ব্যাংকগুলোর ব্যয় বাড়বে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের পদোন্নতি ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন। একটি বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এই কাজটি করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা চেয়েছি। ব্যাংখ্যা হাতে পাওয়ার এ বিষয়ে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে বেশ ক্ষুব্ধ।