অবজ্ঞাপূর্ণ বাদশাহ কারুন ও তার ধ্বংসাবশেষ
- এলামী মো: কাউসার কায়রো (মিসর) থেকে
- ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কারুনের পরিচিতি : প্রথম দিকে কারুন হজরত মুসা আ:-এর প্রতি ঈমান এনেছিল এবং তাঁর অন্যতম সাহাবি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের ধনসম্পদের অহঙ্কারে গর্বিত হয়ে পড়ে। আল্লাহর নবীর বিরোধিতা করতে থাকে। হজরত মুসা আ: কারুনকে জাকাত দিতে বললেন। জাকাতের হিসাব দেখে কারুনের মাথা খারাপ হয়ে গেল। শুধু উট, গাধা, ঘোড়া বকরী বা জাকাতে পশুর সংখ্যা দাঁড়াল কয়েক লাখ। হজরত মুসা আ: যখন শুধু পশুসম্পদের জাকাতের হিসাব দিলেন, তখন কারুন বলল, মুসা! আমি তোমার বদ মতলব বুঝতে পারছি। জাকাতের নামে আমার ধন-রতœ নিয়ে তুমি মালদার হতে চাও? সেটি হচ্ছে না। হজরত মুসা আ: বললেন, ‘তোমার ধনসম্পদের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। মালের জাকাত দেয়া আল্লাহর হুকুম।’
কৃপণ কারুন জবাবে বলল, ‘আল্লাহর ভয় যখন দেখাচ্ছ, তখন মালের কিছু জাকাত দিতে পারি এক শর্তে। তোমার ভাই হারুনের মতো আমাকেও যদি খেলাফত দাও, তাহলে আমি জাকাত দেবো। হজরত মুসা আ: বললেন, খিলাফত বা নবুওয়াত দানের ক্ষমতা আমার নেই। আল্লাহ তায়ালা যখন যাকে নবুওয়াত দেয়ার ইচ্ছা করেন।
কারুন বলল, মুসা! আল্লাহ যদি আমাকে খিলাফত না দেন, তবে তিনি কেন আমার কাছে জাকাত দাবি করবেন? আমি নিজের ক্ষমতা, যোগ্যতা ও কৌশলের জোরে এসব ধনসম্পদ রোজগার করেছি। এতে আল্লাহর হক কিভাবে হলো? কারুন তার সঙ্গীদের কে ডেকে বলল দেখ, মুসার জন্য এখন আমাদের ধন-দৌলত রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। সে বলে কিনা মালদাররা মালের জাকাত না দিলে আল্লাহ নারাজ হবেন। সঙ্গীদের একজন বলল, গায়ে খেটে কষ্ট করে টাকা-পয়সা রোজগার করব, আবার তার থেকে বছর বছর জাকাত দিতে হবে! মুসা পয়গাম্বরী পেয়ে যতসব ঝামেলা শুরু করেছে। কারুন বলল, সত্যি বলতে কি জান? মুসা জাকাতের নাম করে আমাদের ধনে বড়লোক হতে চায়। এ কথা শুনে সঙ্গীরা বলে ওঠে ঠিক ঠিক। মুসার মতলব ভালো নয়। এর একটা বিহিত করতেই হবে। কারুনের হুকুম পেয়ে তার এক সঙ্গী একটি অসৎ চরিত্রের মেয়েকে লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে এলো। তাকে অনেক গয়না ও টাকা দিয়ে বলল, ধনপতি কারুনের জন্য তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। মুসা যখন সভায় ওয়াজ-নসিহত করতে উঠবে, তখন আমরা তাকে চরিত্রহীন বলে ঠাট্টা করব। সে সময় তুমি বলবে হ্যাঁ, এ কথা সত্য। ব্যস, শুধু এতটুকু বললেই কাজ সমাধা হয়ে যাবে। এর জন্য দরকার হলে তুমি আরো টাকা পাবে। মেয়েটি চুপ করে রইল। তারপর অনেক বলে-কয়ে রাজি করালো।
তার পর বিকেলে ওয়াজ-নসিহতের সভা বসল। দলে দলে লোকজন এলো হজরত মুসা আ:-এর ওয়াজ-নসিহত শোনার জন্য। কারুনও তার দলবল নিয়ে এলো। হজরত মুসা আ: ওয়াজ করার জন্য মঞ্চে উঠলেন। তিনি ওয়াজ শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় পূর্বপরিকল্পনামতো মিথ্যাবাদী কারুনের লোকজন বলে উঠল হে মুসা! তুমি চরিত্রহীন। উপস্থিত জনতাকে তারা বলল, আমাদের কথা বিশ্বাস না হয়, এই মেয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করুন। এই বলে কারুন মেয়ে লোকটিকে দাঁড় করিয়ে দিলো। সবাই মেয়েটির কথা শোনার জন্য তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রইল। হজরত মুসা আ: মেয়েলোকটিকে বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কি নালিশ আছে বলো! তবে যা বলবে, আল্লাহকে ভয় করে বলবে। মনে রেখ আল্লাহ সব কিছু দেখেন এবং শুনেন।’ হজরত মুসা আ:-এর কথায় মেয়েটির অন্তর কেঁপে উঠল। ফলে কারুন তাকে যে কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, আল্লাহর ভয়ে সে তা ভুলে গেল এবং তার মুখ দিয়ে আল্লাহর কুদরতে এ কথা বের হলো ‘ভাইসব! আপনারা মন দিয়ে শুনুন, ধনপতি কারুন আমাকে লোভ দেখিয়ে নবী মুসা আ:-এর বিরুদ্ধে কুৎসিত কথা বলতে বলেছিল।’ এ কথা বলে মেয়েটি কারুনের দেয়া গয়নাগাটি খুলে ফেলে সভা থেকে চলে গেল।
হজরত মুসা আ: আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানালেন ‘হে পরওয়ার দেগার! জালিম ধনপতি কারুন থেকে আমাদেরকে রক্ষা করো। তার খপ্পরে পড়ে রাজ্যের অন্যরাও বেদ্বীন ও বেঈমান হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার একান্ত ফরিয়াদ পাপাত্মা কারুন থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন।’ দয়াময় আল্লাহ ফেরেশতা জিব্রাইলকে হজরত মুসা আ:-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। জিব্রাইল হজরত মুসা আ:-কে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আল্লাহ আপনার আরজ মঞ্জুর করেছেন। জিব্রাইলের মুখে আল্লাহর বাণী শুনে মুসা আ: তাঁর কওমের লোকদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা শোন, আল্লাহ জালিম ফেরাউনকে যেভাবে ধ্বংস করেছেন। পাপী কারুনকেও সেভাবে ধ্বংস করবেন।’ হজরত মুসা আ:-এর অনুসারীরা তাঁর কথামতো বেদ্বীনের সঙ্গ ত্যাগ করল। এরপর আল্লাহ তায়ালার হুকুমে জমিন কারুনের হাঁটু পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলল। তখন কারুন ব্যাপারটিকে নিছক রসিকতা ভেবে হেসে ফেলল এবং বলল, হে মুসা! এটা তো দেখছি তোমার নতুন জাদু। হজরত মুসা আ: তার কথার কোনো জবাব দিলেন না। অতঃপর তাঁর আরজিতে আল্লাহর হুকুমে জমিন এবার কারুনের জানু থেকে কোমর পর্যন্ত গ্রাস করল। কারুন তখন নিজের বিপদ বুঝতে পারল। বলল, মুসা! তুমি কি ঠাট্টা বুঝ না। তোমার জাদুর খেলা বন্ধ করো। হজরত মুসা আ: এবারো তার কথার কোনো জবাব দিলেন না। আল্লাহর হুকুমে জমিন কারুনের বুক পর্যন্ত গ্রাস করল। নাদান কারুন এত দিনে তার ভুল বুঝতে পারল। সে বুঝল মুসা সত্যি, আল্লাহর নবী। তাঁর নসিহত না শুনে সত্যি সে অনেক বড় ভুল করেছে। মরণ যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে কারুন বলতে লাগল, ভাই মুসা! আমার অপরাধ ক্ষমা করো। আমি না বুঝে তোমার ওপর জুলুম করেছি। আমার ধন-দৌলত সব তুমি নাও। শুধু আমাকে প্রাণে বাঁচাও। কিন্তু কাঁদলে কী হবে, সময় ফুরিয়ে আল্লাহর হুকুম যখন এসে যায়, তখন আর কোনো সুযোগ থাকে না।
কারুনের সঙ্গী-সাথীরা এসব কাণ্ড দেখে হা করে চেয়ে রইল। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারল না। দেখতে দেখতে আল্লাহর হুকুমে জমিন কারুনকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল। আর এভাবেই জালিম কারুন ধ্বংস হলো। তার মৃত্যুর পর বেদ্বীনরা বলতে লাগল, ইচ্ছে করলে, নবী মুসা আ: কারুনকে বাঁচাতে পারতেন। আসলে কারুনের ধন-দৌলতের লোভেই তিনি তা করেননি। লোকমুখে এ কথা প্রচার হলে হজরত মুসা আ: খুবই দুঃখ পেলেন। তিনি এই অপবাদ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার মাবুদ। কারুন যখন নিপাত করেছেন, তখন তার বাড়িঘর, দালানকোঠা, ধন-রতœ, সব কিছু ধ্বংস করে দিন। তা না হলে বেদ্বীনরা আমাকে নানা অপবাদ দেবে।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাথে সাথে হজরত মুসা আ:-এর আরজ মঞ্জুর করে কারুনের দালানকোঠা, ধন-রত্ন, সব কিছু মাটিতে দাবিয়ে গায়েব করে দিলেন।
শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি :
১. অহঙ্কারের পরিণতি : কারুনের মতো যারা তাদের ধনসম্পদ নিয়ে অহঙ্কার করে, তারা শেষ পর্যন্ত পতনের মুখোমুখি হয়।
২. ধনসম্পদ আল্লাহর দান : কারুন তার ধনসম্পদকে তার নিজের অর্জন হিসেবে দেখেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে সব কিছুই আল্লাহর দান।
৩. গরিবদের প্রতি সহানুভূতি : ধনীরা যদি গরিবদের সাহায্য না করেন এবং অহঙ্কারে মগ্ন থাকেন, তবে তাদের পরিণতি হতে পারে অত্যন্ত কঠোর।
৪. বিনয় ও ধন্যবাদ : আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও বিনয়ী মনোভাব একজন মানুষের প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।