১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

‘সিভিল সার্ভিসে পেশাদারিত্বকে প্রাধান্য না দেয়ায় জাতি বঞ্চিত হচ্ছে’

-


কার্যকর জনসেবা নিশ্চিত করতে কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে অর্থাৎ প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে নিজ নিজ ক্যাডারের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তারা পদায়িত হবেন। তারা বলেন, নিজ নিজ মন্ত্রণালয়/বিভাগে পদায়িত না করে বর্তমানে কৃষি ক্যাডার থেকে উপসচিব পুলে যাওয়া কর্মকর্তাকে নৌপরিবহনে, শিক্ষা থেকে যাওয়া কর্মকর্তাকে পানিসম্পদে, স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে পদায়িত করে দুর্নাম করা হচ্ছে যে তারা কর্মদক্ষ নন। এর ফলে পুলের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে, জাতি বঞ্চিত হচ্ছে অভিজ্ঞ সেবা থেকে। গতকাল আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের উদ্যোগে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে ‘জন-আকাক্সক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেমিনার আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক ড. মুহাম্মদ আহসান হাবিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আলোচনায় অংশ নেন, বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট ফিরোজ আহমেদ, প্রফেসর নাসরিন বেগম, কৃষিবিদ আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এসসিবিএ সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মামুন মাহবুব, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদেকুর রহমান সানি।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর বলেন, আমাদের বিদ্যমান সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থায় প্রধান তিনটি সমস্যা রয়েছে। সেগুলো হলো পেশাদারিত্বকে প্রাধান্য না দেয়া, উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কোটা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বরাদ্দ রাখা জুলাই বিপ্লবের সাথে সাংঘর্ষিক। কোনো একটি সেক্টর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায়, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সেই সেক্টরে পদায়িত হয়ে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে পাশ কাটিয়ে কিছু রুটিন কাজ সম্পাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ঘন ঘন সভা করেন। বছরের অধিকাংশ সময় এভাবে পার করে শেষ মুহূর্তে এসে তাড়াহুড়ো করে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচের চেষ্টা করেন। কিছু দিন পর অন্য দফতরে চলে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো দীর্ঘ সময় আটকে থাকে। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয় এবং কাজে ধীরগতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা না পেয়ে জনগণও সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।

তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক সরকারকে সব কার্যক্রমে সহযোগিতা করেন সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা। কিন্তু ভারসাম্যহীন সিভিল সার্ভিস ও একটি ক্যাডারের সীমাহীন আধিপত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের নৈকট্য লাভ সহজ হয়। ফলে, তারা রাজনীতিতে স্বৈরাচারিত্ব কায়েম করার পরামর্শ দিয়ে এবং তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেন। একটি ক্যাডারের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে নেন যা জনগণের কোনো কাজে লাগে না। পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে প্রত্যেক ক্যাডারকে তাদের স্বগোত্রীয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে হবে, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য নিয়ে তিনি বলেন, ২৬টি ক্যাডারের নিয়োগ প্রক্রিয়া এক হলেও বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার সার্ভিস প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান সচিব বা সিনিয়র সচিব হন এবং রাজনৈতিক মন্ত্রীরা নির্বাহী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসন ক্যাডার ২৬টি ক্যাডারের একটি হলেও অন্য ২৫টি ক্যাডারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ব্যবস্থার ফলে এক দিকে ২৫টি ক্যাডারের ক্ষমতায়ন ক্ষুণœ হচ্ছে; ফলে তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষিবিদ আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল বলেন, আমরা এতদিন দেখেছি, জেলাগুলোর ডিসি একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি এবং এসপি দলের সাধারণ সম্পাদকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা রাজনৈতিক দলের হয়ে সাধারণ মানুষের ওপর তাদের কতৃত্ব দেখিয়েছেন। জনগণের সাথে সম্পৃক্তহীন একটি সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছেন তারা।

ছাত্র প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদেকুর রহমান সানি বলেন, বিগত ১৬ বছর ফ্যাসিবাদী সিস্টেম চালু রেখেছিল একটি বিশেষ ক্যাডার। তারা আওয়ামী সরকারের একপাক্ষিক নির্বাচনে সহায়তা করেছে। আমরা এক কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, এখন দরকার হলে আবার এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আমাদের কেন এমনটা হবে যে, কর্মস্থলে নিজ নিজ বিভাগের, সেক্টরের লোকজন থাকবে না?
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তারা বৈষম্য নিরসনের জন্য এই দায়িত্ব নিয়েছেন। মৃত মানুষের পদোন্নতি দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আমলারা যা করছে এটা ইতিহাসে লেখা থাকবে।
কয়েক বছর আগেও যে এমফিল করা ডাক্তার প্রভাষক পদ থেকে অবসরে গেছে তার সাথে কি বৈষম্য হয়নাই? এই বৈষম্য দূর করার দায়িত্ব কি এই সরকারের নেই। সংস্কার কমিশনে সবখানে আমলারা বসে আছে। এই আমলাদের বিরুদ্ধে সংস্কার কমিশনের সামনে কে কথা বলবে। নিশি ভোটের কারিগর ছিল ডিসিরা। এই ডিসিদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সহসমন্বয়ক ডা: মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ও তাহসীন তাবাসসুম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ২৫টি ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সেক্রেটারি, সিনিয়র নেতারাসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement