গাজা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইলি সেনারা
২৪ ঘণ্টায় আরো ৬৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৮
কাতারের দোহায় দীর্ঘ আলোচনার পর গতকাল বুধবার গাজায় যুদ্ধবিরতির নিষ্পত্তিমূলক বিবরণ চূড়ান্ত করার কাছাকাছি পৌঁছেছেন আলোচকরা। মধ্যস্থতাকারী কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের নেতারা অবিলম্বে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফলে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তি নিয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতার আশা প্রকাশ করেছে, খুব দ্রুত একটি চুক্তি সম্পন্ন হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম কান ও চ্যানেল-১৩ জানিয়েছে, গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসরাইল। খবরে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ কমান্ডের পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর ইসরাইলি দখলদার সামরিক বাহিনী গাজা উপত্যকা থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসরাইলি ওই দুই সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে লেবাননের সংবাদমাধ্যম আল-মায়াদিন জানিয়েছে, গাজার যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি নিয়ে আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে গত মঙ্গলবার ঘোষণা করেছে কাতার।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছেন, একটি চুক্তি ‘প্রায় চূড়ান্ত’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একই ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান জানিয়েছিলেন, এ সপ্তাহের মধ্যেই একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম কানের সামরিক প্রতিবেদক ইতাই ব্লুমেনথাল জানিয়েছেন, নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে জানা গেছে, যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ইসরাইলি সেনাবাহিনী রাফাহ সীমান্ত, নেতজারিম ও ফিলাডেলফি করিডোর রুট থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ব্লুমেনথাল আরো উল্লেখ করেছেন, গাজার ভেতর থেকে সেনা সরিয়ে নিলেও ইসরাইল গাজা উপত্যকার চারপাশে আবার সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি ধাপে ধাপে সৈন্য প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করছে। এই চুক্তির অংশ হিসেবে গাজার সীমান্ত বরাবর প্রায় এক কিলোমিটার চওড়া একটি বাফার জোন তৈরি করবে ইসরাইলি বাহিনী। কানের প্রতিবেদক আরো জানিয়েছেন, গাজা থেকে সম্ভাব্য ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে গত মঙ্গলবার ইসরাইল, মিসর ও মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ইসরাইলি দখলদার সরকারের একটি রাজনৈতিক সূত্র দেশটির চ্যানেল ১৩-এ বলেছে, ‘হামাসকে কেবল সামরিক উপায়ে পরাজিত করা সম্ভব নয়। উত্তর গাজা উপত্যকার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই এটি প্রমাণ করে।’ সূত্রটি আরো বলেছে, ‘হামাস আবার তাদের যোদ্ধাদের সংখ্যা প্রায় আগের মতোই বাড়িয়ে নিয়েছে, এটি স্পষ্ট করে দেয় যে কেবল সামরিক চাপ দিয়ে এই সংগঠনকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব নয়।’
ইসরাইলের নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক প্রধান গিওরা আইল্যান্ডও স্বীকার করেছেন যে, গাজার বিষয়ে ইসরাইল ‘চরমভাবে ব্যর্থ’ হয়েছে। তিনি বলেন, দখলদার বাহিনী যুদ্ধের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তা অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আইল্যান্ড চ্যানেল-১৩কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, হামাস তীব্র আঘাতের পরও ফিরে এসেছে। সব বন্দী মুক্ত করা সম্ভব হবে না এবং গাজা থেকে হামাসের কর্তৃত্ব মুছে ফেলার লক্ষ্য অর্জনও অসম্ভব।
আইল্যান্ড আরো উল্লেখ করেন, ইসরাইলি সামরিক চাপ হামাসের ওপর কার্যত কোনো প্রভাব ফেলেনি। তিনি বলেন, বর্তমানে যে যুদ্ধবিরতি এবং বন্দিবিনিময় চুক্তি প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গত মে মাসে প্রস্তাবিত চুক্তির সাথে প্রায় একই রকম। তিনি মন্তব্য করেন, ‘এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং এটি আর নতুন করে শুরু হবে না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও।’ এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই বাস্তবতা মানতে নারাজ। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচসহ সবাই বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন।’
মিসর সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারে প্রস্তুতি ইসরাইলের
আনাদোলু এজেন্সি জানায়, অবশেষে গাজা ও মিসর সীমান্ত বরাবর অবস্থিত ফিলাডেলফি করিডোর থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল। এ তথ্য জানিয়েছে ইসরাইলি সম্প্রচার মাধ্যম কান। কান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে গাজা উপত্যকা থেকে ধীরে ধীরে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতির জন্য গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর দক্ষিণ কমান্ডে সভা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে কান জানিয়েছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই রাফা ক্রসিংয়ের ফিলিস্তিনি দিক থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, ফিলাডেলফি করিডোর (গাজা-মিসর সীমান্ত বরাবর) থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি ইসরাইলি, মিসরীয় এবং মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, হামাসের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী ফিলাডেলফি করিডোর থেকে তাদের সদস্যদের সরিয়ে নেবে। তবে সেনাবাহিনী মধ্য গাজার নেটজারিম অক্ষে তাদের অবস্থান এবং স্থাপন করা অবকাঠামো ভেঙে ফেলতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
জোট ছাড়ার হুমকি
গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়িত হলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জোট ছাড়া হুমকি দিয়েছেন দেশটির উগ্রপন্থী নেতা ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গভির। বেন গভির নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার একজন বিতর্কিত সদস্য। এক প্রতিবেদনে টাইমস অব ইসরাইল বলেছে, বেন গভির দাবি করেছেন যে গত এক বছরে তিনি একাধিকবার হামাসের সাথে বন্দী মুক্তি চুক্তি ব্যর্থ করেছেন।
একইসাথে মন্ত্রিসভার আরেক উগ্রপন্থী নেতা এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচকে আবারো চলমান চুক্তি আলোচনা ব্যর্থ করতে তার সাথে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। বেন গভিরের ভাষ্য, এটি হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ চুক্তি। অবশ্য কট্টরপন্থী এই নেতা নিশ্চিত করেছেন, তারা বিরোধী দলে থাকলেও প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে নামাবে না।
৬৩ ফিলিস্তিনি নিহত
এ দিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বর্বরতায় মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৬৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও আহত হয়েছেন আরো ২৮১ জন। গতকাল বুধবার ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, চারটি পরিবারে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ‘গণহত্যা’ চালিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন মোট ৪৬ হাজার ৭০৭ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় এক লাখ ১০ হাজার ১২ জন।
পশ্চিমতীরে ইসরাইলের বিমান হামলায় নিহত ৬
আলজাজিরা আরো জানায়, অধিকৃত পশ্চিমতীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলের বিমান হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি কিশোর এবং তিন ভাই রয়েছে। ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শরণার্থী শিবিরের একটি ট্র্যাফিক সার্কেলের কাছে একটি ইসরাইলি ড্রোন একদল মানুষকে লক্ষ্য করে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এতে ১৫ বছর বয়সী এক বালকসহ ছয়জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। হামলায় নিহত আরো পাঁচজনের বয়স ২৩ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে তিন ভাইও ছিলেন। এর আগে, চলতি মাসের শুরুতে অধিকৃত পশ্চিমতীরের তাম্মুন শহরে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় একই পরিবারের দুই ফিলিস্তিনি শিশু এবং ২৩ বছর বয়সী এক যুবক নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আলজাজিরার হামদাহ সালহুত বলেছেন, জেনিন ক্যাম্পে ড্রোন হামলাটি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে জোরদার হওয়া ইসরাইলি হামলার অংশ।