বুড়িগঙ্গাতীরে অরক্ষিত ১৪৭ ডকইয়ার্ড
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মালিকরা- রাকিব হোসেন
- ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:০১
সন্ত্রাসের জনপদ ঢাকার কেরানীগঞ্জ তথা বুড়িগঙ্গার তীরে অরক্ষিত ১৪৭টি জাহাজ তৈরি ও মেরামতের ডকইয়ার্ড। চুরি, ডাকাতি ও নির্মাণসামগ্রী লুট হয়ে যাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ডকইয়ার্ড মালিকরা। গতকাল ১৪ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জ তথা বুড়িগঙ্গার তীরে খেজুরবাগ পারগেন্ডারিয়া মিরেরবাগ কোন্ডা, জাজিরা, কাউটাইল ও চরকালীগঞ্জে অবস্থিত বিভিন্ন ডকইয়ার্ড এলাকায় ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত পাঁচ মাসে চুরি ও লুটের ঘটনা ঘটেছে ৫০টিরও বেশি। জাহাজ কেটে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে ১০টি, ছিনতাই হয়েছে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ। চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে সবগুলো ডকইয়ার্ডে।
জানা যায়, স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে উপজেলার আগানগর, শুভাঢ্যা ও কোনডা ইউনিয়নে বুড়িগঙ্গার তীরে দেশের অভ্যন্তরীণ জলপথে চলাচল করা জাহাজ ও লঞ্চ তৈরির ডকইয়ার্ড চালু হয়। তখন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন মালিক ডকইয়ার্ডের মাধ্যমে জাহাজ তৈরি ও মেরামতের কাজ শুরু করেন। ৮০-এর দশকের দিকে এটি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ’৮০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীরের ঢাকার কেরানীগঞ্জ প্রান্তে মিরেরবাগ, চরকালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, হাসনাবাদ, দোলেশ্বর ও কোন্ডা ইউনিয়নে ১৪৭টি ডকইয়ার্ড স্থাপন হয়। যার মধ্যে বেবি সাবের ডকইয়ার্ড, রহমান ডকইয়ার্ড, ভূঁইয়া ডকইয়ার্ড, তরিকুল্লা, সাগর, কুমিল্লা, হাইস্পিড, শহীদ, ভুঁইয়া, মিশু ও ইকবাল চেয়ারম্যানের ডকইয়ার্ড অন্যতম।
নাম না বলা শর্তে কয়েকজন ডকইয়ার্ডের মালিক জানান, গত পাঁচ মাসে ডকইয়ার্ড এলাকায় কমপক্ষে ৫০টি চুরি ও লুটের ঘটনা ঘটেছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর একটি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এই ছিনতাই চুরি ও জাহাজ কেটে নেয়ার ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে। তবে প্রভাবশালীদের কারণে স্থানীয় থানায় ভুক্তভোগীরা মামলা করার পর আপস অপরাধ রফাদফা হয়ে যায়। যে কারণে বিচার না পেয়ে ডকইয়ার্ড মালিক কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে অভিযোগ করেন কয়েকজন মালিক ও শ্রমিক।
যাত্রীবাহী লঞ্চ ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে বুড়িগঙ্গার তীরে । লঞ্চমালিক জাহিদ মেলকার অভিযোগ করে বলেন, গত ২২ অক্টোবর বিকেলে জাহিদ ৮ নামের তার লঞ্চটি চর মিরেরবাগ এলাকার একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা লঞ্চটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এরপর থানায় মামলা করা হলেও এখন পর্যন্ত তার লঞ্চটি উদ্ধার হয়নি। গত ২৭ নভেম্বর ইকবাল চেয়ারম্যানের ডকইয়ার্ড থেকে একটি জাহাজ কেটে গদ্দা হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দু’জনকে আটক করে বলে জানায় ওই ডকইয়ার্ডের শ্রমিক হানিফ। তিনি বলেন, গত পাঁচ মাসে সন্ত্রাসীরা প্রায় ১০টি জাহাজ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। এ ছাড়া ডকইয়ার্ডে থাকা মালামাল চুরি ও লুটের সাথে জড়িত রয়েছে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এই গ্রুপটি গত পাঁচ মাসে ডকইয়ার্ড থেকে ৫০টির ও বেশি লুট ও চুরির ঘটনা সংঘটিত করেছে।
কোন্ডা ইউনিয়নের কাউটাইল এলাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী রয়েছে একই জায়গায় ১২টি ডকইয়ার্ড। যার মধ্যে প্রধান ডকইয়ার্ড, আরবি ডকইয়ার্ড, কান্দাপাড়া ডকইয়ার্ড, হাজী রসুল বক্স ডকইয়ার্ড, সালাম ডকইয়ার্ড, দেশ ডকইয়ার্ড, বসুন্ধরা ডকইয়ার্ড, এম সত্তার ডকইয়ার্ড, দোহার ডকইয়ার্ড, ভাই ভাই ডকইয়ার্ড ও ইসলাম ডকইয়ার্ড অন্যতম।
প্রধান ডকইয়ার্ডের কন্ট্রাক্টার লতিফ জানান, এসব ডকইয়ার্ডে কমপক্ষে ১৩ শ’ শ্রমিক কাজ করেন। জাহাজ তৈরির শ্রমিকরা প্রতিদিন পাঁচ থেকে ৬০০ টাকা হাজিরা পেয়ে থাকেন। একটি জাহাজ তৈরিতে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। পাশাপাশি রঙমিস্ত্রির কাজে জাহাজপ্রতি থাকেন ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক। এসব শ্রমিকরা চাঁদাবাজির শিকার।
কোনডা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতা রঙমিস্ত্রি রাসেলের নেতৃত্বে এখনো চাঁদা আদায় অব্যাহত রয়েছে। রয়েছে বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয়দানকারী কিছু সন্ত্রাসী। এসব সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করছে রঙমিস্ত্রি রাসেল। রাসেলের নেতৃত্বে রয়েছে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্যরা গত পাঁচ মাস ধরে কাউটাইল এলাকার ডকইয়ার্ডে অবৈধ চাঁদা আদায় করছে। গত ১২ জানুয়ারি রাসেল শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে প্রধান ডকইয়ার্ডের চাঁদার দাবিতে হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলে জাহাজ শ্রমিক সেলিম মিয়া, রঙ কন্টাক্টর শাহিন, শ্রমিক আনোয়ার, সোহেল ও রতনসহ পাঁচজন আহত হয়। দু’জন চাঁদাবাজকে ধরে তারা জাজিরা পুলিশ ফাঁড়িতে হস্তান্তর করে। জাজিরা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড শিপইয়ার্ড অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: মাসুম হোসেন পলাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বর্তমানে তাদের ব্যবসার অবস্থা খুবই নাজুক। গত ৭০ বছরে তাদের এরকম খারাপ দিন কখনো যায়নি। তাদের ডকইয়ার্ডে কোনো ক্রেতা আসে না। শত শত জাহাজ বসে আছে। অনেক জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজ কেটে গরদা হিসেবে লোহার দোকানে বিক্রি করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, চুরি ডাকাতি ও ছিনতাই ডকইয়ার্ড এলাকায় অহরহ ঘটেছে। ৫ আগস্টের পর প্রশাসনের তৎপরতা কমে যাওয়ায় আগের চেয়ে অপরাধ বাড়ছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন একটি লঞ্চ ছিনতাইয়ের অভিযোগসহ বেশ কয়টি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। জাহাজ কেটে নেয়ার সময় হাতেনাতে দু’জনকে আটক করেছি। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটে থাকলে এবং কেউ অভিযোগ করলে তার খতিয়ে দেখা হবে।