১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`
প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবন- শেষ

পর্যটক টানতে চাই নির্বিঘœ যাতায়াত, প্রশিক্ষিত গাইড

নতুন ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব ফেলার আশঙ্কা
-


মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নীরবতায় ঘেরা সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। পর্যটকদের জন্য এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ। দেশী বিদেশী মিলে প্রতি বছর গড়ে দুই লাখের বেশি পর্যটক আসছে এই সুন্দরবনে। বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে করণীয় নিয়ে টোয়াস সাধারণ সম্পাদক ও রূপান্তর ইকো-ট্যুরিজমের স্বত্বাধিকারী নাজমুল আজম ডেভিড দৈনিক নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত আলাপে বলেন, সুন্দরবনে বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে গেলে পর্যটকদের সেবা দেবার জন্য দক্ষ গাইড প্রস্তুত করা দরকার। কারণ বিদেশীরা বিশেষ করে খাওয়ার চেয়ে দেখা ও শোনার জন্য আসে। আমরা আতিথেয়তায় ভালো। কিন্তু বিদেশীদের কাছে খাওয়ার চেয়ে আকর্ষণীয় হলো সুন্দরবনের তথ্য, সুন্দরবনের প্রকৃতি এবং এই অঞ্চল সম্পর্কে জানানো। অথচ আমাদের এখানে এমন ধরনের দক্ষ গাইডের খুবই সঙ্কট।

যাতায়াতের পথকে সহজ করতে তার পরামর্শ হলো, যেখান থেকে পর্যটকরা জাহাজে উঠে সেখানেও কোনো ওয়েটিং রুম নেই। এখানে একটা তথ্যকেন্দ্রও থাকতে পারে। দুই-তিন ঘণ্টা যদি তারা আগে চলে আসে তাহলে ওই অল্প সময়ের জন্য কেন তারা হোটেলে যাবে? এখানে সে রকম বিশ্রামাগার থাকলে তারা এখানেই সময় কাটাতে পারে। লাইব্রেরি বা সুন্দরবনের ওপর ভিডিও চিত্র দেখার সুযোগ রাখা যেতে পারে। মাল্টিপারপাস ভবন করলে পর্যটকদের সেবার জন্য তা অনেক ধরনের কাজে আসবে। খুলনা, মংলা ও সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জে- যেখান থেকে পর্যটকরা যাতায়াত করে সেখানে এসব করা যেতে পারে।
ইকো কটেজের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুন্দরবনের পাশে যেসব ইকো কটেজ নির্মিত হয়েছে সেখানে সব সময়ই পর্যটকদের আগমন হচ্ছে। সেখানেও একটা স্থানীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে। মাস্টারপ্লানে আমরা যেসব ইকো ভিলেজের কথা বলেছিলাম বন বিভাগ সেগুলোকে সেভাবে নিচ্ছে না। তাদের ধারণা ভুল। কটেজ উন্নয়নের যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটার ব্যাপারে কারো কোনো উদ্যোগ নেই। এদেরকে প্রণোদনা দেয়া, নীতিমালা করে এই শিল্পকে বিকাশ করা উচিত।

পর্যটকদের যাতায়াতের ব্যাপারে তিনি বলেন, সুন্দরবনে আসার ও যাওয়ার জন্য যে ব্যবস্থাগুলো, বিশেষ করে জাহাজে করে পর্যটকরা যে যায়, সেটাতে ওঠা-নামার জন্য কোনো জেটি নেই। খুলনা থেকে পর্যটকরা যে জাহাজে উঠবে সেখানে কোনো সুবন্দোবস্ত নেই। নৌকা বা ট্রলারে করে গিয়ে জাহাজে উঠতে হয় পর্যটকদের। সুন্দরবনের স্পটগুলো আরো মনোরম করে সাজানো দরকার। তিনি বলেন, সুন্দরবনের ব্রান্ডিং ও মার্কেটিং করা প্রয়োজন। সংস্কৃতিকে তুলে ধরার ব্যবস্থা থাকা উচিত। স্থানীয় সংস্কৃতি দেখতে ও উপভোগ করতে বিদেশী পর্যটকরা অনেক বেশি পছন্দ করে। স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চায়। বিদেশী পর্যটকদের সাথে স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয়ের সুযোগ করে দিতে হবে। স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে যারা জড়িত তাদেরকে বিদেশী পর্যটকদের উপযোগী করে তৈরি করা। আমাদের ওখানকার স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে নানা কারণে। সুন্দরবন অঞ্চলকেন্দ্রিক আমাদের যে লোক সংস্কৃতি আছে তা তুলে ধরার জন্য পদক্ষেপ নেয়া। এসব বিদেশীদের সুন্দরবনে আসতে ও টানতে সহযোগিতা করবে। আমাদের এখানে প্রকৃতির অপার বিস্ময় এই সুন্দরবন নিয়ে কোনো ধরনের মার্কেটিং নেই। নেই কোনো প্রমোশনাল কাজ।

বন বিভাগের যে জনবল আছে তাদেরকে আরো প্রশিক্ষিত ও আধুনিক করতে হবে। বন সম্পর্কে তারা যতটা জানে তা এক্সপ্লেইন বা বর্ণনা করতে পারে না। এ ব্যাপারে তাদেরকে দক্ষ করে তোলা। ফরেস্ট বিভাগের দায়িত্ব হলো বনকে রক্ষা করা। আর পর্যটনের কাজ হলো মানুষকে পর্যটকদের সেবা দেয়া। বন্দুক নিয়ে যিনি লোক পাহারা দিচ্ছে তাকে সেবার মানসিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের ঘাটতি আছে। বন বিভাগকে আমরা বলেছি, এর ভেতরে একটা পর্যটনের সেল বা ইউনিট করা হোক। তারা ৫-৭ জন মিলে কাজ করবে। পর্যটকদের কথা শুনবে, অপারেটদের কথা শুনবে। সরকারের কাছে পর্যটকদের চাহিদার কথা জানাবে। পাশাপাশি জাহাজের ক্রু ও স্টাফদেরও পর্যটকদেরকে পরিচালনা করার মতো দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। তারা এসব বিষয়ে অনেক কিছুই জানে না। তাদের পছন্দ বুঝতে ও জানতে হবে। যারা গাইডিং করবে প্রতি বছর তাদের দক্ষতা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মূল্যায়নের কোনো পদ্ধতি নেই। গাইডদেরকে আমরা পর্যাপ্ত ভাতা প্রদান করি না। যা দেয়া হয় তাতে তারা গাইড পেশায় টিকে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

শুল্ক ও করের ব্যাপারে নাজমুল আজম বলেন, এখন সমস্যা হলো ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হযেছে। অর্থাৎ কোনো ট্রিপে যদি খরচ আসে ৬ লাখ টাকা, তাহলে সরকারকে ৯০ হাজার টাকা আগে কর দিতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই ৬ লাখ টাকার একটা বড় অংশ যায় জাহাজের, খাদ্য, জ¦ালানি, সরকারের ট্যাক্স। জ¦ালানি ও খাদ্য যখন কিনি তখন কিন্তু আমরা ভ্যাট দিচ্ছি। তাহলে আমরা কতবার ভ্যাট দেবো। আর কত শতাংশ মুনাফা করব? ৫ লাখ ১০ হাজার টাকার মধ্যে এত খরচ করে কত লাভ করব, এটা সরকারকে আমরা বোঝাতে পারছি না। চলতি বছর থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এই নিয়মের ফলে অনিয়ম তৈরির পথ সৃষ্টি করে দেয়া হচ্ছে। এটাতে সরকারের রাজস্ব আয় থেকে কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হবে। সরকারের ঘরে পাঁচ টাকা জমা দেবে আর ওরা নেবে ৫ টাকা। আমাদের দশ টাকা ছাড় দেবে। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। সুন্দরবনের খরচ কিন্তু অনেক বেশি। কারণ সুন্দরবন এমন একটা জায়গা যেখানে আগে ভ্যাট ট্যাক্স জমা দিয়ে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়। ফলে ব্যয় বাড়বেই পর্যটকদের।

পর্যটকদের আকর্ষণ নিয়ে টোয়াস নেতা বলেন, এখন দেখছি এসি জাহাজ বা লঞ্চগুলো পর্যটক ভালোই পাচ্ছে। কিন্তু নন-এসিগুলোতে অর্থাৎ নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষগুলো যেসব লঞ্চ বা জাহাজ ব্যবহার করে সেখানে পর্যটক তুলনামূলক কম। গত কয়েক বছরের তুলনায় কম। কারণ তাদের আয় বাড়েনি। কিন্তু বিলাসবহুল জাহাজে যারা যান তারা করপোরেটের টাকায় যান। নিজেদের অর্থ ব্যয় করতে হয় না। আবার তাদের অঢেল টাকা। ২০১৩ সালের পর থেকে বিদেশী পর্যটক কমতে কমতে তলানিতে চলে গেছে। তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, বিদেশী পর্যটকরা ৭-৮ জনের ছোট ছোট দলে আসে। তারা অতিরিক্ত জনসমাগম পছন্দ করে না। তারা লাইন ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে চায় না। তাদেরকে আমরা ছুটির দিন বাদ দিয়ে ওয়ার্কিং ডেতে বা কর্মদিবসে নিয়ে যাই। তাতে ভিড় কম থাকে। তারা নিরিবিলি পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে দেখতে পারে। তিনি বলেন, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই সুন্দরবনের ওপর ভালো কোনো ভিডিও ডকুমেন্টারি আজো করতে পারি নি। যা দেখে বিদেশী পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement