বড় হচ্ছে বাংলাদেশের অ্যাগ্রিগেটস বাজার
এক দশকে বেড়েছে ৭ গুণ- শাহ আলম নূর
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২৯
ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে তালমিলিয়ে বাংলাদেশে বড় হচ্ছে অ্যাগ্রিগেটসের বাজার। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন নব্বই দশকের পর থেকে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। এতে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অ্যাগ্রিগেটস চাহিদা। একই সাথে নির্মাণ সামগ্রীগুলোর মধ্যে সিমেন্ট, রড, বালু এবং অ্যাগ্রিগেটস বা পাথরের খোয়ার চাহিদাও বাড়ছে অব্যাহতভাবে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি টন অ্যাগ্রিগেটসের চাহিদা রয়েছে। এর বাজারমূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১০ সালের আগে অ্যাগ্রিগেটসের বাজার ছিল প্রায় এক কোটি টন। এর বাজারমূল্য ৫,০০০ কোটি টাকা ছিল।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন এক সময় দেশে শুধু বড় নির্মাণকাজে অ্যাগ্রিগেটস ব্যবহার হয়ে থাকলেও গত ১০ বছরে চিত্র পাল্টেছে অনেকটাই। ব্যক্তিপর্যায়ে যারা বাড়ি নির্মাণ করছেন তারাও এখন ফাউন্ডেশন কিংবা ছাদ ঢালাইয়ের জন্য অ্যাগ্রিগেটস ব্যবহার করছেন। কারণ সাধারণ ইটের খোয়ার চেয়ে অ্যাগ্রিগেটসের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ১০ বছর আগেও যেখানে বাংলাদেশে অ্যাগ্রিগেটসের চাহিদা ছিল এক কোটি টনের কাছাকাছি, এখন তা বেড়ে ৭ কোটি টনে পৌঁছেছে। টাকার অঙ্কে এই বাজার ৩০ হাজার কোটিরও বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন যেকোনো অবকাঠামো দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্মাণ করা হয়। যেকোন অবকাঠামো নির্মাণে যদি প্রাকৃতিক এগ্রিগেটস ব্যবহার করা হয় তবে তার স্থায়িত্ব হয় ১০০ বছরের বেশি। আর যদি কোনো অবকাঠামো সাধারণ ইট দিয়ে তৈরি করা হয় তবে তার স্থায়িত্ব হয় অনেক কম। গত এক দশকে বিপুল পরিমাণে স্থাপনার নির্মাণ টেকসই উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে অ্যাগ্রিগেটস ব্যবহার করা হয়েছে। তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশে কিছু পাথর বা অ্যাগ্রিগেটস আসে সিলেট বিভাগ থেকে। অপরিকল্পিত উপায়ে পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে আদালত ২০১৭ সালে এসব কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে। তখন থেকেই আমাদের দেশে পাথর বা অ্যাগ্রিগেটস শতভাগ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন অ্যাগ্রিগেটস মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটস এবং সাধারণ অ্যাগ্রিগেটস। ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদনে প্রয়োজন উন্নতমানের পাথর এবং আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনারিজ যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট আকারে অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটসের চাহিদা বছরে প্রায় দেড় কোটি টন। ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটস বাংলাদেশের নির্মাণ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানিগুলো মূলত আরব আমিরাত এবং ওমান থেকে আমদানি করে থাকে।
অপর দিকে সাধারণ মানের অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদিত হয় সেকেলে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে যা স্থানীয়ভাবে বোমা মেশিন নামে পরিচিত। এ ধরনের অ্যাগ্রিগেটসের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টন যার মূল অংশ ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা আমদানি করেন।
ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সিমেন্ট ও রেডিমিক্স কোম্পানিগুলো অন্যতম। ক্রাউন ও ফ্রেশ সিমেন্টসহ বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কোম্পানি মূলত রেডিমিক্স তৈরির জন্য এ ধরনের অ্যাগ্রিগেটস আমদানি করছে। অপর দিকে বহুজাতিক সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাফার্জহোলসিম ভারতের মেঘালয়ে তাদের নিজস্ব কোয়ারি থেকে চুনাপাথর উত্তোলন করে দেশেই ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। লাফার্জহোলসিমের ক্রেতা মূলত দেশের নেতৃস্থানীয় রেডিমিক্স এবং ডেভেলপার কোম্পানিগুলো।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন বাংলাদেশের পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং সিলেট অঞ্চলের স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে বোল্ডার আকারে পাথর এনে দেশে ক্রাশিং করে চাহিদা মেটাচ্ছেন। তাদের ক্রাশিং মেশিনগুলো বেশির ভাগই সেকেলে এবং পরিবেশবান্ধব নয়, যা ক্লিয়ার সাইজ অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদনের অন্যতম অন্তরায়।
সিলেট অঞ্চলের পাথর ব্যবসায়ীরা বলছেন এখন তারা আগের মতো ভারত থেকে এলসির মাধ্যমে চাহিদা মতো চুনাপাথর আনতে পারছেন না। এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতে পরিবেশ আইন ও খনিজসম্পদ আহরণ আইনের ক্রমবর্ধমান কড়াকড়ির কারণে পাথর খনিতে উত্তোলন কার্যক্রমে বিধি নিষেধ বাড়ছে। ফলে চাহিদা মেটাতে তাই অবৈধ পথে আমদানি বাড়ছে। তবে সম্প্রতি উচ্চ আদালত সিলেট অঞ্চলের বেশ কিছু পাথর খনি থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে, যা এই শিল্পে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
দেশের বাজারে ক্রাউন সিমেন্ট অ্যাগ্রিগেটস আমদানি শুরু করে তিন বছর আগে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত রেডিমিক্স বানানোর জন্য এবং সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে সরবরাহের জন্য ওমান ও আরব আমিরাত থেকে অ্যাগ্রিগেটস আমদানি করে থাকে। তারা স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেন অ্যাগ্রিগেটস কেনেন না জানতে চাইলে ক্রাউন সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, আমাদের যে কোয়ালিটির অ্যাগ্রিগেটস লাগে তা স্থানীয়রা দিতে পারেন না। তাই পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে আমরা নিজেরাই আমদানি করি।
ইকুইটি প্রপার্টির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজুল হক বলেন আমরা সাধারণত ওমান, আরব আমিরাত থেকে অ্যাগ্রিগেটস আমদানি করে থাকি। দেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঐ কোয়ালিটির অ্যাগ্রিগেটস পাওয়া যায় না। তারা একই কোয়ালিটির অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন করতে চাইলে তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং উন্নত প্রযুক্তি ক্রাশিং ইউনিট বসাতে হবে। সেই সাথে আমদানি করতে হবে উন্নতমানের চুনাপাথর।
লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন সম্পর্কে কথা হয় কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, আমরা ভারতের মেঘালয়ে নিজেদের খনি থেকে চুনাপাথর আমদানি করে থাকি। কোয়ালিটি অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন করতে আমরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির একটি অ্যাগ্রিগেটস প্ল্যান্ট স্থাপন করেছি। গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক আমরা তাদের প্রয়োজনীয় আকারে অ্যাগ্রিগেটস সরবরাহ করতে সক্ষম। দেশেই অ্যাগ্রিগেটস উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছি আমরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন বড় হচ্ছে অ্যাগ্রিগেটসের বাজার। তবে এখন পর্যন্ত এ খাত নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। এতে পণ্যের মান নিশ্চিত করা অনেক সময় কঠিন হয়। এ জন্য এ খাতের জন্য একটি নীতিমালা থাকা দরকার। কারণ অ্যাগ্রিগেটসের চাহিদা বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। আগামী দিনে ইটভাটাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তখন নির্মাণকাজের অন্যতম প্রধান উপকরণ হবে অ্যাগ্রিগেটস। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দেশে আধুনকি প্রযুক্তির অ্যাগ্রিগেটস প্ল্যান্ট স্থাপন জরুরি। এ ছাড়া মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে অতিরিক্ত দামে বিদেশ থেকে আমদানির পথেই হাঁটতে হবে দেশের উদ্যোক্তাদের।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা