টিউলিপকে নিয়ে মানসিক দোটানায় স্টারমার
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২৮
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে সে দেশের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্ত করার দাবি সত্ত্বেও, কিয়ার স্টারমারের সহযোগী প্যাট ম্যাকফ্যাডেন তাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তারপরও কিয়ার স্টারমার টিউলিপকে নিয়ে তীব্র মানসিক দোটানায় পড়েছেন। কারণ ব্রিটিশ মিডিয়াগুলো টিউলিপ সিদ্দিকের ক্ষমতাচ্যুত খালা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সরকারের সাথে নতুন যোগসূত্র উদঘাটন করতে শুরু করেছে।
স্কাই নিউজের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, টিউলিপ যদি পদত্যাগ করেন, আর নাই করেন তারপরও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ক্ষতি যা হওয়ার এরই মধ্যে তা হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ক্রমশ চাপ বাড়ছে তার ভাগ্নি ও ব্রিটিশমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের ওপরে। হাসিনার আওয়ামী লীগ ও তার ঘনিষ্ঠ দু’জন ব্যক্তির কাছ থেকে উপহার হিসেবে ফ্ল্যাট নেয়ার কারণে অনেক ব্রিটিশ এমপিই এখন টিউলিপের পদত্যাগ দাবি করছেন। টিউলিপ অবশ্য তার খালা হাসিনার সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে এক সময় টিউলিপ কী ধরনের গর্ব করেছেন তা প্রকাশ করতে শুরু করেছে ব্রিটিশ মিডিয়াগুলো।
ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক রব পাওয়েল লিখেছেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির মধ্যে এমন একটি পয়েন্ট আছে, যার পরে পদত্যাগ আরো বেশি প্রশ্নের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। ফলে টিউলিপ সিদ্দিকের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একই রকম বিপদ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারেরও। যদি টিউলিপ এখন পদত্যাগ করেন, তাহলে অসংখ্য মানুষ বিস্মিত হবেন যে, এটা কেন আরো আগে হলো না। কেন ডাউনিং স্ট্রিট এই কাহিনীকে এতটা পথ আসতে দিলো। এতে আরো ক্ষতি হবে।
স্কাই নিউজের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিনিধি জন ক্রেইগ লিখেছেন, টিউলিপ বাংলাদেশে তার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তার খালা শেখ হাসিনা থেকে দূরত্ব রক্ষার চেষ্টা করেছেন। দাবি করেছেন, তারা কখনোই রাজনীতি নিয়ে কথা বলেননি। অথচ এসব মিথ্যা। ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে হাসিনাকে নিয়ে টিউলিপের গর্ব করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেয়ার। ব্রিটিশ মিডিয়াগুলোতে শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় টিউলিপ যে ব্রিটেনের রাজনীতিতে উঠে আসেন তারও ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ পাচ্ছে।
টাইমস শেখ হাসিনার সাবেক বাসভবন গণভবনের ধ্বংসাবশেষে পাওয়া মিসেস সিদ্দিকের তৈরি লেবার পোস্টার এবং লিফলেটের ছবি প্রকাশ করেছে। এবং স্কাই নিউজ মিসেস সিদ্দিকের লেখা পুরনো ব্লগ পোস্টগুলো খতিয়ে দেখেছে, যেখানে তিনি বাংলাদেশের নির্বাচনে তার খালার সাথে প্রচারণা চালানো এবং তার বিজয় উদযাপনের বর্ণনা দিয়েছেন।
২০০৮ সালের শেষের দিকে লেখা এক ব্লগ পোস্টে, টিউলিপ তখন একজন শ্রমিককর্মী ছিলেন, স্কাই নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, টিউলিপ সমর্থকদের বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে! শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত! আমি আনন্দিত! ‘আমি সারা দিন শেখ হাসিনার সাথে প্রচারণা চালিয়েছি তাই আমার আর বেশি কিছু লেখার শক্তি নেই তবে আমি আগামীকাল লিখব। তবে, আমি কয়েকটি ছবি আপলোড করার লোভ সামলাতে পারছি না। এটি শেখ হাসিনার মুখ, যা তিনি একটি অজেয় নির্বাচনী এলাকা থেকে ফলাফল শোনার ঠিক আগে দেখেছিলেন।
হাসিনা তার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিককে ব্রিটিশ রাজনীতিতে তার ক্যারিয়ারের প্রাথমিক পর্যায়ে সাহায্য করেছিলেন, যা মন্ত্রীর রাজনৈতিক সংযোগ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ক্যামডেনের প্রাক্তন মেয়র নাসিম আলী টিউলিপের মা শেখ রেহানা এবং আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর কাছ থেকে তার ক্যারিয়ারকে সমর্থন করার জন্য চাপের কথা স্বীকার করেছিলেন। আলী বলেন, চৌধুরী তাকে ‘সর্বদা ... টিউলিপকে সমর্থন করার জন্য’ বলবেন।
ব্রিটেনের বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রী পিটার কিলি এরই মধ্যে বলেছেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে যে তদন্ত হচ্ছে, তাতে যা বেরিয়ে আসবে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার। স্কাই নিউজের সানডে মর্নিং প্রোগ্রামে ট্রেভর ফিলিপসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। হাসিনার রাজনীতির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা টিউলিপকে উপহার হিসেবে লন্ডনে একাধিক ফ্ল্যাট দিয়েছেন। তাতে তিনি বসবাসও করেছেন। কিন্তু তা সরকারি নথিতে জানাননি। তবে একটি ফ্ল্যাটকে তিনি নিজের ঠিকানা হিসেবে সরকারি ডকুমেন্টে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোনো অন্যায় করেননি বলে দাবি করেছেন টিউলিপ। প্রধানমন্ত্রী স্টারমারও টিউলিপের প্রশংসা করেছেন। ফলে শুধু টিউলিপ সিদ্দিক নয়, বিপদে পড়ে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও তার সরকার। এসব বাড়ির ছবিসহ ব্রিটিশ মিডিয়াগুলো সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
এ নিয়ে বাংলাদেশে যতটা, তার চেয়ে বেশি তোলপাড় চলছে ব্রিটিশ রাজনীতিতে। নিজের দলের এবং বিরোধী দলের নেতারা এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। অনেকেই দাবি তুলছেন টিউলিপকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে। পিটার কিলি বলেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া দরকার। কর্তৃপক্ষকে নিরপেক্ষ তদন্ত করতেই আমরা অধিক ক্ষমতা দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ যা বলবেন কিয়ের স্টারমার তাই শুনবেন।
স্কাই নিউজের অনুসন্ধান বলছে টিউলিপ একটি ব্লগে শেখ হাসিনার সাথে রাজনৈতিকভাবে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তা নিয়ে গর্ব প্রকাশ এবং তাদের একসাথে ছবি প্রকাশ করেছেন। ২০০৮ সালের শেষের দিকে এবং ২০০৯ সালের শুরুর দিকে টিউলিপ সিদ্দিক তখন লেবার পার্টির একজন কর্মী। তখন লেখা পোস্টে তার খালা শেখ হাসিনার জাতীয় নির্বাচনে তার জন্য যে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং কিভাবে তার বিজয় উদযাপন করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। জন ক্রেইগ আরো লিখেছেন, আমাদের অনুসন্ধান দ্য টাইমসের নতুন রিপোর্টের সাথে কাকতালীয়ভাবে মিলে যাচ্ছে।
এদিকে ডাচি অব ল্যাঙ্কাস্টারের চ্যান্সেলর প্যাট ম্যাকফ্যাডেন বলেছেন, এথিকস পর্যবেক্ষক বা ওয়াচডগের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করবে লেবার পার্টি। রিপোর্ট পাওয়ার পরই টিউলিপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দেখা হবে টিউলিপ মন্ত্রিত্বের বিধি বা অন্য কোনো আইন লঙ্ঘন করেছেন কি না। এটাই সঠিক পথ। একই সাথে টিউলিপকে বরখাস্ত করে তার পদে অন্য কাউকে নিয়োগ দেয়ার ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছেন স্টারমার। তার দলের নেতারা বলছেন স্টারমারকে টিউলিপের দুর্নীতির জট থেকে মুক্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু জট ক্রমশ বাড়ছে। টিউলিপ লন্ডনের যে ফ্ল্যাটে কয়েক বছর বসবাস করেন সেই ফ্ল্যাট একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা হয়েছিল। করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত ওই কোম্পানির নাম পেডরক ভেঞ্চারস। এই কোম্পানির সাথে বাংলাদেশের দু’জন ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড এলাকার ওই ফ্ল্যাটটি ২০০০ সালে দুই লাখ ৪৩ হাজার পাউন্ড দিয়ে পেডরক ভেঞ্চারস কেনে। ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া পানামা পেপারস এবং ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সরবরাহ করা নথিতে দেখা যায়, পেডরক ভেঞ্চারস কিনে নেয় হারবার্টন এস এ নামে একটি অফশোর কোম্পানি। এরপর বন্ধ হয়ে যায় পেডরক ভেঞ্চারস। ২০০৯ সালের মার্চে একটি ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন আজমিনাকে উপহার দেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মঈন গনি। সে সময় আজমিনার বয়স ছিল ১৮ বছর। তখন তার কোনো আয়রোজগার ছিল না। আজমিনা সিদ্দিককে ফ্ল্যাটটি হস্তান্তরের সময় ভূমি নিবন্ধনসংক্রান্ত নথিতে নাসিম আলীর স্বাক্ষরের সাথে তার সাথে পানামা পেপার্সে থাকা স্বাক্ষরের মিল রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। ২০১২ ও ২০১৪ সালে নিজের ঠিকানা হিসেবে ওই ফ্ল্যাট উল্লেখ করেছিলেন তিনি। টিউলিপের স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পারসিও ২০১৬ সালে তার ঠিকানা হিসেবে ওই ফ্ল্যাটের উল্লেখ করেছিলেন।
পরের বছর টিউলিপ যুক্তরাজ্যের এমপি নির্বাচিত হন। পরে তার বোন আজমিনা সিদ্দিক ওই ফ্ল্যাট ছয় লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করেন। টিউলিপ সিদ্দিক ২০০৪ সালে ডেভেলপার আব্দুল মোতালিফের কাছ থেকে যে অ্যাপার্টমেন্টটি উপহার হিসেবে পান, যার সাথে তার খালা শেখ হাসিনার সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ সংসদীয় রেকর্ড অনুসারে, টিউলিপ এখনো ওই বাড়ির মালিক এবং বার্ষিক ১০,০০০ পাউন্ডেরও বেশি দামে এটি ভাড়া দেন। এ ছাড়া টিউলিপের মা শেখ রেহানা উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড হিথের কাছে একটি বাড়িতে ভাড়া ছাড়াই থাকেন। বাড়িটি শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের পরিবারের মালিকানাধীন, যিনি এখন বাংলাদেশে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ এবং দুর্নীতির অভিযোগে আটক রয়েছেন। এর আগে টিউলিপের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সংসদীয় মান কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে এবং ১৪ মাস ধরে আরেকটি বাড়ি থেকে ভাড়া বাবদ আয় ঘোষণা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে।
এ দিকে গতকাল সোমবার লন্ডনের বাসা থেকে বের হওয়ার টিউলিপ সিদ্দিককে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তিনি পদত্যাগ করবেন কি না। তবে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান তিনি। স্কাই নিউজে ২৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন সাংবাদিক টিউলিপকে প্রশ্ন করছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন কি না? এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বারবার ‘গুড মর্নিং’ বা শুভ সকাল বলে পাশ কাটিয়ে যান টিউলিপ। দু’বার প্রশ্ন করা হলে দু’বারই তিনি একই কথা বলেন। পরে গাড়িতে উঠে, বেরিয়ে যান ব্রিটেনের এই মন্ত্রী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা