শুল্কহার বৃদ্ধি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে
- শাহ আলম নূর
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২৭
শুল্কহার বাড়ানো হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ কমে যাবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে বিদ্যমান শিল্প কারখানা চালু রাখা কষ্টকর হবে। পাশাপাশি নতুন শিল্পকারখানা চালু করাও দুষ্কর হয়ে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিসহ কর্মসংস্থানে। শুল্কহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে শিল্প উদ্যোক্তারা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পাশাপাশি স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৪৩টি পণ্যের ওপর ভ্যাট ও শুল্ককর দ্বিগুণ করার উদ্যোগের পাশাপাশি মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসার প্রভৃতি শিল্পের আয়কর ১০ শতাংশ হতে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেবে।
তিনি বলেন, নতুন এ সিদ্ধান্তের কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হবে। তা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে দীর্ঘমেয়াদি কর সুবিধার পাশাপাশি নীতি ধারাবাহিকতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যক। তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব নিঃসন্দেহে দেশের শিল্প খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যবসার খরচ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের এমন মূল্যবৃদ্ধির প্রয়াস সামগ্রিক বিনিয়োগের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমাবে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করবে। ফলে রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলবে এবং এটি স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকে হ্রাস করবে বলে তিনি মনে করেন।
এ দিকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার এবং কম্প্রেসার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর করের হার দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখিত খাতসমূহে প্রতিশ্রুত কর সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার কথা থাকলেও তা হঠাৎ করে যে পরিবর্তন করা হলো তা বিনিয়োগের জন্য একটি নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম নয়া দিগন্তকে বলেন, ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে গ্রাহকদের ব্যয় আরো বৃদ্ধি পাবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইতোমধ্যেই হ্রাস পাচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা করে অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নতুন এ সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
উদ্বিগ্ন উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো : এ দিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পথে উড়োজাহাজের টিকিটে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণে এই খাতে বিশেষ করে দেশের ভেতর যাত্রীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন উড়োজাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ চাপে পড়বে। কারণ শুল্ক বাড়ানো হলে তা শেষ পর্যন্ত টিকিটের দামে প্রভাব ফেলবে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের টিকিটে আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করেছে। নতুন সিদ্ধান্তের আলোকে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সদস্য দেশগুলোয় যাওয়ার টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাইরে এশিয়ার অন্যান্য দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে শুল্ক টিকিটপ্রতি ২০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করা হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক ৩০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০০০ টাকা করা হয়েছে।
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার যখন শুল্ক বাড়ায় তখন তাদের খরচের মধ্যে তা অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। উড়োজাহাজ ভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বাড়লে চাহিদা প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, শুল্ক বাড়ানো হলে টিকিটের দামে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। অতিরিক্ত শুল্কের মাধ্যমে যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া যায় তার তুলনায় সরকারের পরোক্ষ ক্ষতি বেশি হয় বলে তিনি মনে করেন। বর্তমান শুল্ক হারে সরকার আরো বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারত। শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা কমে যাবে। এজন্য তিনি এনবিআরকে বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করার অনুরোধ জানান।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা সাধারণত জাতীয় বাজেটের সময় কর বা শুল্ক বাড়ানোর কথা চিন্তা করেন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে আসায় এখাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।
এ দিকে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি মহাসচিব ইমরান হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, হোটেল, রেস্তোরাঁয় ভ্যাটের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্তে এখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন ৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ এখনো ভ্যাটের আওতার বাইরে রয়েছে। প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার ঘাটতি মেটাতে পারে বলে তিনি মনে করেন। আইএমএফ এর শর্ত মানতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত দেশের জনগণের ওপর ইচ্ছে মতো করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া কোনো সুষ্ঠু সমাধান নয় বলে তিনি জানান।
ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি ক্যাবের
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর পরামর্শে মুঠোফোন-ইন্টারনেট, ওষুধ, এলপি গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, ফলের রস, সব ধরনের তাজা ফল, সাবান ও ডিটারজেন্ট, কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, মোবাইল সেবা ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ম্যাট্রেস, ফেরো ম্যাঙ্গানিজ (রড তৈরির কাঁচামাল), বার্নিশ ইত্যাদিসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষের এমনিতেই নিত্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, সেখানে এই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারনে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরেক দফা তাদের পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে তাদের জীবনে নতুন করে আবারো অস্থিরতা তৈরি করবে। তাই এই অধ্যাদেশ বাতিল অথবা আগামী রমজান পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ কার্যকর না করার জন্য তিনি দাবি জানান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা