১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬
`
আলজাজিরার অনুসন্ধান

মিয়ানমারের মুক্ত অঞ্চল পরিচালনা করাই বিদ্রোহীদের আসল যুদ্ধ

-

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরার সাংবাদিকরা মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের হাতে কারেন রাজ্যের সামরিক বাহিনী থেকে মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করে দেখতে পয়েছেন সেখানে গণতন্ত্রপন্থী শক্তির পরবর্তী কাজ হলো বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এটিই তাদের এখন আসল যুদ্ধ। থাও হতি নামে এক নারী বিদ্রোহী ২০২১ সালে ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন আমাদের হাতে প্ল্যাকার্ড এবং তাদের কাছে বন্দুক ছিল। আলজাজিরার অনুসন্ধান বলছে, মাঝখানের চার বছরে, থাও হতি এবং তার প্রজন্মের মিয়ানমারে অনেক কিছু বদলে গেছে।
গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নে মিয়ানমারের জান্তাবাহিনী শত শত মানুষকে হত্যা করার পর, তরুণরা থাইল্যান্ড, ভারত এবং চীনের সাথে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পালিয়ে যায়।
থাও হতিও কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের কাছে আশ্রয় নেন। যারা ১৯৪০ সাল থেকে মিয়ানমারের পূর্ব কারেন রাজ্যে, যা কায়িন রাজ্য নামেও পরিচিত, কারেন জনগণের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করে আসছে। তাদের কাছে আগত নতুনদের বেঁচে থাকার জন্যে একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হতো, যার মধ্যে ছিল অস্ত্র প্রশিক্ষণ, দুর্গম ভূখণ্ডে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করা এবং মৌলিক আত্মরক্ষার দক্ষতা।
থাও হতি মনে করেন, বন্দুক চালানো তাকে শক্তির অনুভূতি দিয়েছিল, যখন তিনি তার সহযোদ্ধাদের ওপর সামরিক গণহত্যা দেখার পর শক্তিহীনভাবে তাকে অনুভব করেছিলেন। এখন তিনি বলেন, আমি বন্দুক পছন্দ করি, এ কথা বলার সময় তার মুখে একটি উচ্ছল হাসি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, আমি এখানে বিপ্লবে যোগ দিতে এসেছিলাম, কিন্তু একজন মহিলা হিসেবে, আরো বাধা রয়েছে, মানসিকভাবে আমি এটি করতে চাই, কিন্তু শারীরিকভাবে আমি পারব না।
নিপীড়নের পাঠ
থাও হতি কারেনদের অনুমোদিত একটি স্কুল খুলেন যেখানে তারা সঙ্ঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত ১০০ জনেরও বেশি শিশুকে পড়ান। পূর্ব মিয়ানমারের জঙ্গলে অতি গোপনে পরিচালনা করা হয় স্কুলটি। কারণ সেনাবাহিনী কারেনদের সমান্তরাল সরকারি পরিষেবা- স্কুল এবং হাসপাতালের মতো ব্যবস্থাপনার ওপর বিমান হামলা চালায়। বোমা হামলার লক্ষ্য হলো কারেন স্বায়ত্তশাসনের বৈধতা প্রদানকারী উদীয়মান প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস করা।
সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন স্কুলগুলোর বিপরীতে, থাও হতি তার স্কুলে শিশুদের কারেন ভাষায় শিক্ষা দেন এবং মিয়ানমারের ইতিহাসের একটি কারেন-কেন্দ্রিক সংস্করণ শেখা, যেখানে কারেনদের দশকের পর দশক ধরে যে নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা প্রায়ই সরকারি বর্ণনা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
কারেনরা কয়েক দশক ধরে তাদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করেছে, কিন্তু নতুন, গণতন্ত্রপন্থী বাহিনী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে জোট বাঁধার সাথে সাথে, কারেনদের মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাত তীব্রতর হয়েছে। বিশেষ করে গত বছরে, সামরিক বাহিনী সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিশাল ভূখণ্ড হারিয়েছে, যার মধ্যে পশ্চিমে রাখাইন রাজ্যের প্রায় পুরো অংশ এবং পূর্বে উত্তর শান রাজ্য রয়েছে। পাশাপাশি উত্তরে কাচিন রাজ্যের বিশাল অংশ এবং কারেন রাজ্যের আরও কিছু অংশ হারিয়েছে জান্তা বাহিনী। কিন্তু বিদ্রোহী যোদ্ধারা যত বেশি অঞ্চল দখল করছে, ততই তারা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে : তা হচ্ছে মুক্ত এলাকাগুলো এটি পরিচালনা করা।
সমান্তরাল প্রশাসন
মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দখল করা কারেন রাজ্যের কাইকডন, প্রতিরোধ বাহিনীর দ্বারা জয়ী অন্যান্য বৃহৎ শহরে বিধ্বংসী বিমান হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। আলজাজিরার সাংবাদিকরা সা¤প্র্রতিক কাইকডন সফরের সময়, শহরের রেস্তোরাঁগুলো বেসামরিক নাগরিক এবং কারেন সৈন্যদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল যারা বার্মিজ তরকারি খাচ্ছিল। দোকানগুলো খোলা ছিল এবং গৃহস্থালির জিনিসপত্র এবং ঐতিহ্যবাহী কারেন কাপড় বিক্রি করছিল, যখন প্রধান রাস্তাটি যানবাহনে ভরা ছিল।
শহরের ৩৩ বছর বয়সী কেএনইউ-নিযুক্ত প্রশাসক সোয়ে খান্ত বলেছেন, মুক্ত অঞ্চলের জন্য তার বড় পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি জানান, আমি জনসাধারণের কাজ শেষ করতে। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করতে এবং প্লাস্টিক পরিষ্কার করতে চাই। সোয়ে খান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এক বছর পরে নির্বাচনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে তিনি নিযুক্ত হওয়ার পরিবর্তে অবশেষে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার সাথে একমত। আলজাজিরাকে সোয়ে বলেন, জনগণ যদি এটি চায়, আমি পদটি গ্রহণ করব। যদি তারা অন্য কাউকে বেছে নেয়, আমি তা হস্তান্তর করব। সামরিক শাসন এ শহরের মানুষকে সম্পূর্ণ অবহেলা করেছে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সোয়ে খান্ত সমান্তরাল প্রশাসন পরিচালনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, মনে হচ্ছে এত দ্রুত এগোচ্ছি, কিন্তু আমরা খুব বেশি দূর এগোতে পারছি না।
কাওকারেইক টাউনশিপের সেক্রেটারি মায়া আয়ে ১২ বছর ধরে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যিনি বর্তমানে টাউনশিপের তৃতীয় সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ এবং মানবসম্পদের অভাব স্থানীয় অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছে এবং কেএনইউ-এর জনসেবা প্রদানের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছে। তিনি জানান, কোনো কারখানা নেই, কোনো শিল্প নেই, আপনি আপনার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য এখানে কাজ করতে পারবেন না,সঙ্ঘাত এবং কষ্টের কারণে। তরুণরা নিকটবর্তী থাইল্যান্ডে বসবাসের জন্য চলে যাবে।
মিয়ানমারের ৩৩ বছর বয়সী প্রাক্তন পুলিশ অফিসার উইন হতুন গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের গ্রেফতার এবং নির্যাতনের আদেশ অনুসরণ করার পরিবর্তে কেএনইউতে যোগ দেন। তিনি বলেন, বিশ্বাস করতাম পুলিশ ভালো এবং জনগণকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। বাস্তবতা হলো দুর্নীতি, বৈষম্য এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি চলছে। উইন হতুন, মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার জাতিগত সদস্য হিসেবে বলেন, পুলিশ কারেন সহকর্মীদের সাথে অত্যন্ত অন্যায্য আচরণ করেছে। ১০ বছরের পুলিশ সার্ভিসে একাধিকবার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। প্রতিবারই পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করা হয়। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর তিনি তার স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে কারেন-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পালিয়ে যান। এখন তিনি কেএনইউ-এর পুলিশ বাহিনীতে কাজ করছেন।
সেনাবাহিনীর বর্বরতা এবং বিপ্লব বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এ ধারণার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে, থাও হতির মতো তরুণ শিক্ষিত, পেশাদার এবং উইন হতুনের মতো বছরের পর বছর ধরে সরকারি চাকরি করা ব্যক্তিরা, সদ্য মুক্ত অঞ্চলের প্রশাসনে মানবসম্পদ শূন্যস্থান পূরণ করতে এসেছেন, কিন্তু বেশিরভাগই ভেবেছিলেন সামরিক বাহিনীকে উৎখাতের লড়াইয়ে মাত্র কয়েক মাস বা সর্বাধিক কয়েক বছর সময় লাগবে। ধারাবাহিক পরাজয় এবং অন্যান্য অভূতপূর্ব বিপর্যয় সত্ত্বেও সামরিক বাহিনী টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement