শুঁটকিপল্লীর জেলেদের নিরাপত্তাহীন জীবন : নেই সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র
- হামিদ সরকার দুবলারচর সুন্দরবন (খুলনা) ঘুরে এসে
- ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০৫
প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবন
- নিরাপত্তাহীন বসবাস এই শুঁটকিপল্লীর ৩৫ হাজার জেলের
- ৭ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষেত্রে নেই কোনো সরকারি পরিকল্পনা
- সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে তারা নিজেদের জ¦ালানি চাহিদা মেটাচ্ছে
বঙ্গোপসাগর ও পশুর নদীর পাশে সাধারণ জনবসতি থেকে বিচ্ছিন্ন এবং দুর্গম একটি এলাকা হলো সুন্দরবনের দুবলারচর। সরকার বছরে গড়ে ৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করছে। অথচ কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও এখানেই গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বড় শুঁটকি তৈরির এলাকা। মাত্র পাঁচ মাসের বসতির এই দুবলারচর শুঁটকিপল্লী দেশের অর্থনীতির কেন্দ্র। লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, খলিসা, ইছা, ভেদা, পোঁয়াসহ অন্তত ১০০ প্রজাতির শুঁটকি তৈরি করা হয় এ পল্লিতে। কয়েক লক্ষ মানুষের কর্মযজ্ঞ সেখানে। এই শুঁটকিই দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে প্রতি বছর। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। জেলে, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, খাবার পানি, বিদ্যুৎ, জ¦ালানি, স্বাস্থ্যসেবা পায় না এই পল্লীতে বসবাসরত ৩৫ হাজার জেলেরা। নেই কোনো জরুরি স্পিডবোট। এখানে শুধু পুরুষরাই বাস করে। জেলেরা বলেন, মার্চের পর তারা এখান থেকে চলে যান, যে যার যার এলাকায়, পরিবারের কাছে। তখন এখানে বসবাস করার মতো কোনো ধরনের সুযোগ থাকে। সব পানিতে তলিয়ে যায়।
বন বিভাগ থেতে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুবলার চর থেকে শুঁটকি পাওয়া গিয়েছিল চার হাজার ১০৫ টন। বন বিভাগের আয় হয়েছিল দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ১০০ টন শুঁটকি থেকে আয় হয়েছিল ছয় কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয় হয়েছে সরকারের সাড়ে ৬ কোটি টাকার মতো। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, তাদের একজনই গত বছর প্রায় তিন কোটি টাকার মতো রাজস্ব দিয়েছে। তবে সারা বছরের হিসাব করলে ২০০ কোটি টাকার অর্থনীতির কেন্দ্র এটি।
সরেজমিন সুন্দনবনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের মূলত আলোরকোল, মাঝেরকেল্লা, নারকেল বাড়ীয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চরে হয় মাছ শুকানোর কাজ। জেলেরা প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ মাস এখানে ব্যবসার অনুমতি পান। এই চরে কাজ করেন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। যাদের তিন থেকে পাঁচটি নিজস্ব মাছ ধরার ট্রলার আছে তাদেরকে ডাকা হয় মহাজন বলে। যাদের ট্রলারের সংখ্যা আরো বেশি তাদেরকে ডাকা হয় বহরদার। শুঁটকির কাজে নিযুক্ত জেলেরা এসব মহাজন ও বহরদারদের হয়ে কাজ করেন।
দুবলারচরের জেলে, মহাজন ও শ্রমিকদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, সাধারণত লইট্টা, তেলফ্যাসা, ছুরি, বৈরাগী, চাকা চিংড়ি, রূপচাঁদা শুঁটকি করা হয়। কাঁচা মাছ শুকাতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ দিন। পাইকারদের কাছে গড়ে প্রতি কেজি শুঁটকি বিক্রি করা হয় ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকায়। এখান থেকেই পাইকাররা শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। এই শুঁটকিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। এই শুঁটকিই সারা দেশে চলে যায়। চরে মাছ ধরার কাজে আছে শত শত ট্রলার। এসব ট্রলার মেরামতের জন্য আছে কারখানা। নিজস্ব জেনারেটর ব্যবস্থায় কারখানাগুলো চালানো হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে ওই চরে।
শুঁটকি উৎপাদক-ব্যবসায়ী ও জেলে দুবলার চরের ইমরান নয়া দিগন্তকে জানান, এখানে শুঁটকির ধরনে এবং মাছের আকার অনুযায়ী কেজি এবং মনপ্রতি দাম ধরা হয়। রূপচাঁদা বড় আকারের প্রতি কেজি ৪ হাজার টাকা। আর ছোট আকারের আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফ্যাইসা শুঁটকি সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা প্রতি কেজি, চিংড়ির শুঁটকি প্রতি কেজি ৪০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, চাপিলা সাড়ে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের শুঁটকিতে কেমিক্যাল ও লবণ মেশানো হয়। আমরা কোনো কিছুই মেশাই না। আমাদের এখানকার শুঁটকি সারা দেশে চলে যায়।
জেলে মিরাজ শেখ বলেন, সাধারণত সামুদ্রিক তেলাপিয়া, ফ্যাইসাসহ অন্যান্য ছোট মাছ চাতালে ও লম্বাটে লইট্টা, ছুরি মাছগুলোকে বাঁশের আড়ায় ঝুলিয়ে শুকাতে দেয়া হয়।
প্রায় ৩০ বছর ধরে এই চরে মহাজনের কাজ করা ইসমাইল হোসেন বলেন, এখান থেকে শুঁটকি নেয়ার জন্য ১০ থেকে ১২টি পরিবহন ব্যবস্থা আছে। তারা রংপুর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় শুঁটকি পাঠিয়ে দেয়। দেশের শুঁটকির বড় অংশ যায় দুবলার চর থেকে। তার মতে, সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া হলে এই চরের শুঁটকি রফতানি করে প্রতি বছর হাজার হাজার ডলার আয় করা যেত।
শুঁটকি পল্লীতে কাজ করেন আবদুস সালাম সরদারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এখানে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস কাজ করেন চুক্তিতে। এরপর এলাকায় ফিরে গিয়ে মাছের ঘেরের কাজ করেন। তিনি বলেন, পাঁচ মাস কাজের জন্য এক লাখ টাকা চুক্তিতে তিনি এসেছেন। অন্য যারা কাজ করেন তারা ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত পায় চুক্তিতে। আবদুস সালাম প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে বসে ড্রামের জন্য জাল বানাচ্ছিলেন। কারণ তিনি মাছ ধরতে যাননি। এই ড্রাম দিয়ে মাছ ধরার জাল নদী ও সাগরে ভাসিয়ে রাখা হয়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি। রাতে ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে যান সকালে ঘাটে বা পল্লীতে ফেরেন। আবার দুপুরে গিয়ে সকালে ফেরেন। যারা দুরে যায় মাছ ধরতে তারা ১০ দিন পর আসেন।
আ: সালাম জানান, তিনি বলেন, এখানকার শুঁটকি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। প্রতিদিন গড়ে এক মণ শুঁটকি তৈরি করা হয়। আবার কখনো ২০ মণও হয়। গুঁড়া চিংড়ির শুঁটকি করতে একদিন লাগে। সকালে দিলে বিকেলেই শুঁটকি হয়ে যায়। জেলে, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ হলো, এখানে জেলেদের উন্নয়নের জন্য সরকারের কোনো ধরনের পরিকল্পপনা ও চিন্তাভাবনা নেই। জেলেদের ওয়েলফেয়ারের জন্য বন বিভাগ কোনো ধরনের অর্থ ব্যয় করে না। ২০ হাজার জেলে কাজ করে। তারা বলেন, সাগরে মাছ ধরতে গেলে অনেক সময় পানি সাপ নামে একধরনের বিষাক্ত সাপের কামড় খেতে হয়। এ জন্য এখানে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা রাখা হলে তাদের জীবনের ঝুঁকি কমে যেত। এ ছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে দুবলার চর থেকে তাদের নদীপথে বাগেরহাট বা খুলনায় হাসপাতালে নিতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এ জন্য জরুরিভাবে একটি সরকারি হাসপাতালের দাবি করেন তারা।
ওষুধ বিক্রেতা ও গ্রাম্য চিকিৎসক তারিকুল বলেন, এই দুর্গম চরে চিকিৎসা দেয়ার সরকারি উদ্যোগ নাই। অধিকাংশ রোগী আসেন পেটের ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিয়ে। আমরা তাদের চাহিদামতো শুধু ওষুধ বিক্রি করি।
দুবলারচর ফিসারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাঁচ মাসে সিজনাল ৮-১০ কোটি টাকার বাণিজ্যকেন্দ্র। এই সুন্দরবনের মৎস্য খাতটি সম্পূর্ণভাবে মৎস্য বিভাগের অধীনে দিয়ে দেয়া উচিত। বন বিভাগ থাকতে পারে সাথে, তবে দায়িত্ব দেয়া উচিত মৎস্য বিভাগকে। তাতে এখানে যেসব সমস্যা ও জটিলতা আছে তা অনেকটাই কমে যাবে। তিনি বলেন, দুবলার চর শুঁটকি পল্লীটা হবে অর্থনীতির বড় একটা সহায়ক। তিনি বলেন, জেলেদের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র দরকার। একটা জরুরি ভিত্তিতে স্পিডবোট দরকার। যেকোনো সময় এই রিমোট এলাকায় একজন জেলে অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত মংলা বা খুলনায় চিকিৎসার জন্য আনা সম্ভব হবে। তাদের খাবারের জন্য মিষ্টি পানির কুপ দরকার। যেটা ছিল সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। নেই কোনো সাইক্লোন শেল্টার।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিমের সাথে গতকাল মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, গত অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছিল প্রায়। এবার আমরা বেশি আতঙ্কিত। কারণ জেলেরা বলছে তারা মাছ পাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা মাছ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, গতবার সাড়ে ৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। সরকার বছরে ৬-৭ কোটি টাকা আয় করে। এ ছাড়া যারা মাছ ধরে এমন পেশাজীবী হলো ১০ থেকে ১২ হাজার জেলে। তারা প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। রফতানি করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায়। বাইরেও যায়। তিনি বলেন, ২-৩শ’ কোটি টাকার অর্থনীতির কেন্দ্র হতেই পারে এটা।
স্পিডবোট ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র্রর বিষয় নিয়ে বন সংরক্ষক খুলনা অঞ্চলের মিহির কুমার দো এর সাথে গতকাল মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, দুবলারচর শুঁটকিপল্লী ও জেলেদের উন্নয়নের জন্য পৃথক কোনো প্রকল্প নেই বা কোনো কার্যক্রম নেই বলে তিনি জানান। তবে আলোরকলের ওখানে একটা পানির প্লান্ট আছে। তারা চাইলে সেখান থেকে পানি নিতে পারেন। ভেতরে কূপ আছে। ছোট ছোট। সেখান থেকে তারা মিষ্টি পানি পায়। এ ছাড়া বন বিভাগ থেকে সেখানকার বিভিন্ন চরে পুকুর খনন করেছে। সেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে এই বন কর্মকর্তা বলেন, তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে কোনো স্পিডবোট নেই। তবে বন বিভাগের ও কোস্টগার্ডের স্পিডবোট থাকে। কোনো জরুরি ঘটনা হলে তারা সহায়তা করে। ল্যান্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। তবে তাদের জন্য একটা স্পিডবোট থাকা প্রয়োজন বলেও তিনি জানান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা