আবারো বড় বড় নৌযান ব্রহ্মপুত্রে
২৮৩ কিলোমিটার এলাকায় খননকাজ- খাদেমুল বাবুল জামালপুর
- ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০, আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:২১
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র এশিয়ার অন্যতম গুরুতপুর্ণ নদ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি এরেন্ডাবাড়ী থেকে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার বুক চিড়ে প্রবাহিত হচ্ছে এটি। বক্ররেখা আকৃতির এই নদের দৈর্ঘ্য ২৮৩ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ২০০ মিটার।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) সূত্র মোতাবেক পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের প্রদত্ত পরিচিতি নাম্বার ৩৭ নম্বর। কালের পরিক্রমায় খরস্রোতা ও গভীর জলমগ্ন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে ।
বর্ষা মৌসুমে থৈ-থৈ পানি আর শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য ব্রহ্মপুত্র নদের বুক দিয়ে হেঁটে পার হন পথচারী। নাব্যতা সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের লাভজনক ২৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘতম এ নৌপথ।
জানা যায়, ২০১৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ময়মনসিংহ থেকে ২২৭ কিলোমিটর নদী খননের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। দুই হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু করা হয়।
সংস্কৃত ভাষায় ব্রহ্মপুত্রের অর্থ ‘ব্রহ্মার পুত্র’। এজন্য একে ‘ব্রহ্মপুত্র নদ’ বলা হয়। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব নাম ছিল লৌহিত্য। এক সময় ব্রহ্মপুত্রের বুক চিড়ে চলাচল করতো ব্যবসায়ীদের বড় বড় পালতোলা নৌযান বা জাহাজ। বণিকদের বিশ্রাম বা ব্যবসার জন্য স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছিল গঞ্জ বা শহর।
তাই ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তীরে গড়ে উঠেছে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামের চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, জামালপুর সদর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, গফরগাঁও এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরববাজার নৌবন্দরসহ অসংখ্য গঞ্জ ও শহর।
গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাডী, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরববাজার অংশে নদের ২২৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদের খননকাজ চলছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় খননকাজ সমাপ্তও হয়েছে বলে জানা গেছে । কিছু কিছু এলাকায় চলমান রয়েছে। তবে কোনো কোনো এলাকায় এখনো শুরুই হয়নি।
জামালপুরের মেলান্দহ ডেফলা ঘাট ইসলামপুরের পলবান্ধা ও গোয়ালের চর ইউনিয়ন পর্যন্ত চলছে খননকাজ। খননের পরও ইসলামপুরের পাইলিংঘাট এলাকা দিয়ে সম্প্রতি আব্দুল মজিদ নামে এক ব্যক্তিকে হাঁটুপানি মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পার হতে দেখা যায় ।
আব্দুল মজিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, গত বছর ড্রেজার দিয়ে খুদিছে (খনন করছে) বছর না ঘুরতেই যা আর তাই অইছে।
অর্থাৎ খনন করার পর নদটি আরার প্রায় আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে! অথচ এই বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে সরকারি বিপুল পরিমাণ টাকা। যার ফলাফল শূন্য হতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
মেলান্দহ ডেফলা ঘাট রামডাঙ্গা এলাকার সেলিম মিয়া বলেন, এটা তো নদী খনন না। বালুর ব্যবসা আর সরকারি টাকায় পকেট ভরার কল্প নাটক ছিল। তিনি আরো বলেন জানি না কত হাজার কোটি টাকার কাম এটি। তাদের মতে অপরিকল্পিত খনন করা হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। এই খননকাজ করে নদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব যে হবে না নদীর পাড়ের মানুষ হিসাবে আমরা অনুমানেই বলতে পারি ।
প্রায় দুই মাসের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নদের বেশির ভাগ এলাকা এখন স্রোত ও প্রাণহীন এক মরা খাল।
নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কয়েক বছরে যেসব এলাকায় খনন করা হয়েছে। সেসব এলাকার মানুষ এখন হতাশ। তারা বলছেন, খনন করে কোনো লাভ হয়নি। খননের পরও নদের অনেক স্থানের পাড় ভাঙন রোধে ডাম্পিং করা হয়েছে বালুর বস্তা। এতে ভাঙন রোধ হয়েছে কিন্তু নদের বালু আবার চলে এসেছে নদে।
বর্ষা মৌসুমে ওইসব বালু বস্তা থেকে বালু বেরিয়ে ভরাট হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ।
খনন করে নদের বিভিন্ন তীরে স্তূপ করে রাখা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ বালু। বর্ষায় মৌসুমে এর দুই-তৃতীয়াংশ বন্যার পানিতে মিশে আবার ভরাট করেছে নদের বুক। সৃষ্টি হয়েছে চরের পর চর।
সব কিছু মিলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও এর কোনো সুফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে জনমনে । এ কারণে ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
২০২৩ সালের মে মাসে ময়মনসিংহের তরুণ সমাজ খনন করা ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে দাঁড়িয়ে মৃত ব্রহ্মপুত্র নামে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে প্রতিবাদও জানায়।
নদটি খনন করা হচ্ছে। কিন্তু নদের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। এক পাশ দিয়ে খনন করা হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে আবার আগের মতো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে খননের সুফল দেখছি না বলে জানান, পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মো: ফজলুল হক আকন্দ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার ও প্রস্থ ২০০ মিটার।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি উত্তর বঙ্গের গাইবান্ধা জেলা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার বুক চিড়ে প্রবাহিত। এক কালের খরস্রোতা ও জলমগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদ এখন নাব্যতাহীন মরা খাল।
২০১৮ সালে ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর সাথে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননের জন্য ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর বড় অংশ ব্যয় (২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা) ধরা হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননে।
জানা যায়, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্দেশ্য ছিল নাব্যতা ফিরে আনা। এতে সারা বছর নদের বুকে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌ যান চলাচল নিশ্চিত হবে। যেন শুকনো মৌসুমেও ৯০ মিটার প্রস্তে ৬ থেকে ১০ ফুট গভীর পানি থাকে। ফলে এটি দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথে উন্নীত হবে।
কৃষিকাজেও পানি সরবরাহ করা হবে নদ থেকে ।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, ১২ ফুট গভীরতার নৌপথকে প্রথম শ্রেণী এবং ৮ থেকে ১০ ফুট গভীরতার নৌপথকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথ বলা হয় ।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন শুরু হয় ২০১৯ সালের জুন। ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে কাজের তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, গত জুন পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ খনন হয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদারের অফিসিয়াল মোবাইল নম্বর একাধিক বার ফোন করা হয়। কিন্তু ফোনটি আর ব্যবহার হচ্ছে না বলে জানা যায়।
তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, নদটি খননে একই সময়ে ১০০টি খননযন্ত্র বা ড্রেজারের প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, নদী খননে সরকারের বছরে বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা।
সূত্রটি জানায় ঠিকাদারদের কার্যাদেশ ও চুক্তি মোতাবেক খননকৃত বালু নদীর তীর থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফেলার কথা ছিল । কিন্তু বালু ফেলা হচ্ছে নদের কূল ঘেঁষে।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওই এলাকার মানুষ তাদের ফসিল জমিতে ফসল নষ্ট করে বালু রাখতে দিতে রাজি নয় ।
জানা যায়, দেওয়ানগঞ্জের মানুষ তাদের ফসলি জমি নষ্ট করে বালু রাখায় বাধা দিয়ে ছিল। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স জমির মালিকদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করে সুরাহা করেছেন। বতর্মানে খনন চলছে তবে ধীরগতিতে। বালু রাখা হচ্ছে নদের তীর ঘেঁষে।
ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বলেন, খননে উত্তোলিত বালু নিলামে নেয়ার শর্তে এই উপজেলার মানুষ তাদের ফসিল জমি দিতে সম্মত হয়েছে ।
সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্র নদের খনন কাজ জামালপুর জেলার ইসলামপুর অংশে সরেজমিনে পরির্দশন করা হয়। কথা বলা হয় নদের পাড়ের মানুদের সাথে। তারা বলছেন, খনন করে বালু নদের কূল ঘেঁষে রাখায় অনেক স্থানে সেগুলো আবার নদে মিশে গেছে। যেসব স্থানে বালু নিলাম করার সুযোগ আছে, সেসব জায়গায় নদটি এলোমেলোভাবে খনন করার অভিযোগ হয়েছে।
কাজের ধীরগতির কারণে গত বর্ষা মৌসুমে খনন করা বালু আবারো ফিরে এসে খনন হওয়া জায়গা ভরাট যাচ্ছে।
খননকাজে নিয়োজিত কর্মী আব্দুল কাদের বলেন, বালু এক কিলোমিটার দূরে রাখার কথা কিন্তু জমির মালিকরা বাধা দিচ্ছে।
সরকারি নিলাম ডাকে খননের বালু বিক্রি করে দেয়ার কথা। কিন্তু আইনি জটিলতায় সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
গত জানুয়ারিতে ময়মনসিংহের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (রাজস্ব) জেলায় এ পর্যন্ত ৫৪ লাখ ঘনফুট বালু নিলামে বিক্রি করা হয়েছেন। অন্তত ২০০ কোটি ঘনফুট বালু অবিক্রীত রয়েছে। এ ছাড়া অনেক অবিক্রীত বালুর স্থান এখনো পরিমাপ করা হয়নি।
নদের পাড়ের বাসিন্দাদের আশঙ্কা বর্ষা মৌসুমে পাড়ে রাখা বালু আবার নদের সাথে মিশে যাবে।
নদের পাড়ের বাসিন্দা আবদুল মান্নান বললেন, যেভাবে খননেন বালু পাড়ে রাখা হয়, তা বর্ষায় আবার নদীতেই যাবে।
সুফল পাওয়া নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ নদী খনন প্রকল্পটি নিয়ে গত জুন মাসে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে প্রকল্পের নানা দুর্বলতা তুলে ধরা হয়।
যার একটি সঠিকভাবে খননকাজ হচ্ছে না। পরিদর্শনকারী দলটি পানির গভীরতা ৮ থেকে ১০ ফুটের স্থলে পান মাত্র সাড়ে চার ফুট। প্রতিবেদনে বলা হয়, নদে মূল (ক্যাপিটাল) ড্রেজিং করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণ (মেইনটেনের) ড্রেজিংয়ের প্রকট রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ দল মনে করে, মূল ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি ড্রেজিং করা না হলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খননকাজটি করতে হয় খুব দ্রুত। কিন্তু ধীরে ধীতে অল্প অল্প করে কাজ করলে সুফল পাওয়া যায় না। টাকাগুলো পানিতে ঢালা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, দুই বছরের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন শেষ করলে নৌপথটি কাজে লাগাবে। এখন যে হারে গালগল্প চলছে, তাতে মূল ড্রেজিংয়ের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং না হলে বন্যার পর নদী আগের মতো ভরাট হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, বিগত ১০ বছরে বেশ কিছু নদী খনন করা হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সেগুলো আগের মতো নাব্যতা হারিয়েছে।
ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু করা হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে। খননকাজ শুরুর পর থেকেই নাগরিক সমাজ নানা অভিযোগ করে আসছিল খননের নামে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের নাম মুছে ১০০ মিটার খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদের পাড়েই রাখা হচ্ছে খননের বালু।
চার বছর খনন করলেও এখনো বাড়েনি নাব্যতা। উল্টো খনন হওয়া নদের বুকে স্থানে স্থানে জেগে উঠছে অসংখ্য চর।
পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, যে প্রযুক্তিতে খনন করা হচ্ছে এতে নাব্যতা ফিরে আসার আশা করছি না আমরা।