০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে দুর্নীতি- শেষ

ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে লুটপাট ১৯৫ কোটি টাকা

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে দুর্নীতি- শেষ -


বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পে নজিরবিহীন অনিয়ম উদঘাটিত হয়েছে। কনসালট্যান্ট নিয়োগসহ ২১ হাজার ১৬৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ বেবিচক এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম-এডিসি পরস্পর যোগসাজসে দুই চুক্তির এক-চতুর্থাংশ টাকাই লোপাট করেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় এ ব্যাপারে অডিট সম্পাদন করেছে। খোদ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেই এই প্রকল্পে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাটের চিত্র বেড়িয়ে এসেছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এই প্রকল্পের ৯টি খাতে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে মোট ১৯৫ কোটি ৩৯ লাখ ৪৪ হাজার ১৭৭ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এতে সরকারে বড়ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

কোভিড-১৯ বাবদ ভুয়া বিলের মাধ্যমে অর্থ লোপাট : তথ্য মতে, চুক্তির আওতায় কার্য সম্পাদনকালে প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনওসিডি-জেভির সুপারিশক্রমে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই সময়ের জন্য আইপিএ-২৫ তারিখ: ১৪-০৮-২০২২ এর মাধ্যমে কোভিড-১৯ বাবদ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৩৫ কোটি ৭৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। অথচ চুক্তির বিওকিউতে কোভিড-১৯ নামে কোনো আইটেমের উল্লেখ নেই, এমনকি প্রকল্পের ডিপিপিতেও কোভিড-১৯ বাবদ কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ ছাড়া ২০২২ সালের জুলাই মাসে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ বাংলাদেশে ছিল না। এ ক্ষেত্রে চুক্তি বহির্ভূতভাবে কোভিড-১৯ বাবদ বিল পরিশোধ করায় সরকারের ৩৫ কোটি ৭৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে অর্থ লোপাট : পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশক্রমে ডাক্ট ব্যাংক নির্মাণকাজের নক্সাগত পরিবর্তনের কারণে ভেরিয়েশন করা হয়। ওই ভেরিয়েশনের মাধ্যমে ৭৪৮১.৫৩ মিটার সিরামিক ডাক্ট ব্যাংক নির্মাণের পরিবর্তে একই পরিমাণ কনক্রিট ডাক্ট ব্যাংক নির্মাণ করা হয়। ৭৪৮১.৫৩ মিটার সিরামিক ডাক্ট ব্যাংকের চুক্তিমূল্য ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৬ টাকা এবং একই পরিমাণ কনক্রিট ডাক্ট ব্যাংকিয়ের মূল্য ৮৯ কোটি ৮৪ লাখ ৯৫ হাজার ১৯০ টাকা। সুতরাং ডিজাইন পরিবর্তনজনিত কারণে ৩৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ লাখ ৪৪৬ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সাশ্রয়কৃত অর্থের ৫০% ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং হিসেবে ঠিকাদার পাবেন। কিন্তু ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হয়েছে ৫৪ কোটি ১০ লাখ ৯ হাজার ৬৯৩.৫৪ টাকা। এ ক্ষেত্রে ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং এর নামে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ভুয়া বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ৬১ হাজার ৪৭০ টাকা।
অপারেশন ও মেইনটেনেন্স এর নামে অর্থ লোপাট: চুক্তি অনুযায়ী টার্মিনালটির নির্মাণ কাজ ৩১-১২-২০২৫ এর মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। টার্মিনালটি নির্মাণ শেষ হওয়ার পর অপারেশন ও মেইনটেনেন্স পিরিয়ড শুরু হবে এবং এর সময়কাল হবে টার্মিনালটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার এক বছর পরে। সে অনুযায়ী অপারেশন ও মেইনটেনেন্সের কাজ শুরু হবে ৩১-১২-২০২৬ তারিখে। কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে টার্মিনাল হস্তান্তরের পূর্বেই ১১-০৪-২০২৩ তারিখে ঠিকাদারকে অপারেশন এন্ড মেইনটেনেন্স বাবদ জালিয়াতি করে চুক্তিকৃত শতভাগ অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৪৭ কোটি ৯৯ লাখ ০৮ হাজার টাকা।

চূর্ণ পাথর আমদানির নামে অর্থ লোপাট: প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য চুক্তি অনুযায়ী চূর্ণ পাথর আমদানির কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এছাড়াও ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট আমদানি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় চ’র্ণ পাথর আমদানি করা হয়নি। তা সত্ত্বেও প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এর সুপারিশক্রমে মূল ঠিকাদারের অনুকূলে সিডি ভ্যাট বাবদ ২২ কোটি ৪৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে, চূর্ণ পাথর আমদানি না করা সত্ত্বেও এর সিডি/ভ্যাট বাবদ অর্থ পরিশোধে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২২ কোটি ৪৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা ।
পরিবর্তিত এসিএমভি সিস্টেম আমদানির নামে ক্ষতি: প্রাপ্ত থথ্যে দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, যদি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রকৃত চুক্তির আইটেম অর্থাৎ এইচভিএসি সিস্টেম (যার কোড-৮৪১৫৮১২০) আমদানি করতো তাহলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সিডি ভ্যাট পুনর্ভরণ বাবদ চুক্তি মূল্যের ২৬.২% প্রয়োজন হতো। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে উক্ত সিস্টেমের পরিবর্তে এসিএমভি-সিস্টেম (যার কোড- ৮৪১৫৯০১০) আমদানি করায় সিডি/ভ্যাট প্রদান করতে হয়েছে চুক্তি মূল্যের ১৯৬%। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত হারে সিডি/ভ্যাট প্রদান করায় ৩৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯ হাজার টাকা প্রকল্পের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বিলম্বে বিল পরিশোধের কারণ দেখিয়ে অর্থ লোপাট: প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিলম্বে বিল পরিশোধের কারণ দেখিয়ে ঠিকাদার কর্তৃক বিলম্বজনিত ক্ষতিপূরণ (ফাইনান্সিয়াল চার্জ) দাবী করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী বিল দাখিলের পরবর্তী ৭০ (সত্তর) দিনের মধ্যে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ৪টি বিল (আইপিসি নং- ২৯, ৩০, ৩১, ৩২,) পরিশোধে কোনরূপ বিলম্ব না হওয়া সত্ত্বেও ঠিকাদারের দাবীকৃত ২ কোটি ৭৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭১ টাকা (ফাইনান্সিয়াল চার্জ) পরিশোধ করা হয়।
সাব-কন্ট্রাক্টর হতে উৎসে মূসক কর্তন না করায় রাজস্ব ক্ষতি: চুক্তির আওতায় বিভিন্ন কাজ করার জন্য ঠিকাদার কর্তৃক সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করা হয়। নিয়োগকৃত সাব-কন্ট্রাক্টরগণকে সম্পাদিত কাজের জন্য জুন ২০২৩ সময় পর্যন্ত ঠিকাদার কর্তৃক রড ক্রয় বাবদ ১২০,৯৯,২৯,১৮৮.৫৬ টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই বিল পরিশোধকালে উৎসে মূসক কর্তনকারী সত্তা হিসেবে ঠিকাদার কর্তৃক ৭.৫% হারে ৯,০৭,৪৪,৬৮৯.০০ টাকা (১২০,৯৯,২৯,১৮৮.৫৬ দ্ধ ৭.৫%) মূসক কর্তনযোগ্য হলেও তা কর্তন করা হয়নি বিধায় ক্রয়কারী কর্তৃক চুক্তিমূল্য পরিশোধকালে প্রদত্ত মূসকের সাথে সমন্বয় করা যায়নি। ফলে সাব-কন্ট্রাক্টর বিল হতে উৎসে মূসক কর্তন না করায় সরকারের ৯ কোটি ৭ লাখ ৪৪ হাজার ৬৮৯ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অযৌক্তিক সুবিধা প্রদানে ক্ষতি : চুক্তির আওতায় বিওকিউ ডিভিশন-৭০৮০০ এর অধীন বৈদ্্ুযতিক ডাক্ট ব্যাংক নির্মাণে সিরামিক মাল্টিপল কনডুইট পাইপ ব্যবহারের পরিবর্তে কনক্রীট মাল্টিপল কনডুইট পাইপ ব্যবহার করে ২১৫ কোটি ২০ লাখ ২৪ হাজার ৩৭৪ টাকা সাশ্রয় দেখানো হয়। এক্ষেত্রে মূল্য হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট পণ্যের গুণগতমান, লাইফ টাইম ও কর্মক্ষমতা কম হলে উহার প্রয়োগ সঠিক হয়নিা। তথাপি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অযৌক্তিকভাবে ৩ কোটি ২২ লাখ ৬৪ হাজার ২৫৬ টাকা পরিশোধ করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
ওভার টাইমের নামে অর্থ লোপাট: চুক্তির ওয়ার্কপ্লান (এপেন্ডিক্স-সি) অনুযায়ী নিয়োজিত পরামর্শকগণ যথাসময়ে সিডিউলে বর্ণিত কাজ সম্পাদন করবেন। এতে কত ‘ম্যান-মানথ’ প্রয়োজন হবে তা বিবেচনায় নিয়েই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চুক্তি সম্পাদন করেছেন। অতিরিক্ত পরামর্শক নিয়োজিত করা বা কম পরামর্শক দ্বারা অতিরিক্ত সময়ে কাজ করিয়ে সিডিউল সময়ে কাজ সম্পন্ন করা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। তথাপি পরামর্শককে প্রাপ্যতা বহির্ভূত ওভারটাইম প্রদান করায় সরকারের ৬৯ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement