যাত্রী ভোগান্তির নাম পঞ্চগড় এক্সপ্রেস
- মনির হোসেন দিনাজপুর থেকে ফিরে
- ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫০
পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা থেকে যাত্রার আগে এবং পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় ফেরার আগে প্রতিদিন স্টেশনে এসে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নাÑ এমন যাত্রী এই রুটে খুব কমই পাওয়া যাবে! ট্রেন চালাতে বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ থেকে যে শিডিউল ঠিক করে দেয়া হয়েছে সেগুলো সময় মেনে কোনো দিনও গন্তব্যের উদ্দেশ্য চলছে না। ভোগান্তির এখানেই শেষ তা কিন্তু নয়, ট্রেনে ওঠার পর গন্তব্য পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেশনে এবং সিগন্যালিংয়ে ভোগান্তি হচ্ছে সঙ্গী। এ সময়ে আবার যাত্রীদেরকে সারাক্ষণ থাকতে হয় চুরি-ছিনতাই আতঙ্কে। কিন্তু নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগ সময় দেখা মেলে না। অপরিচ্ছন্ন ট্রেনের বগিতে মশার উপদ্রবের পাশাপাশি বাথরুম প্রায় থাকছে নোংরা, ভাঙাচোরা। এত কিছুর পরও যাত্রীদের সবচেয়ে যেটি ভালো লাগছে, সেটি হচ্ছে ট্রেনের বগিগুলোর মাইকে ফজরসহ প্রত্যেক পাঁচ ওয়াক্তের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। আজানের পাশাপাশি চুরি-ছিনতাই আর অপ্রীতিকর ঘটনারোধে যাত্রীদের দেয়া হচ্ছে সাবধান বাণী।
গত ৫ আগস্ট রোববার রাতে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনে সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে পাওয়া যায় এমন চিত্র। তবে পঞ্চগড় থেকে সোমবার দুপুরে যে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে সেটিতে যাত্রী ভোগান্তি আগের রাতের থেকে কিছুটা কম ছিল। সাধারণ যাত্রীরা এই রুটে শিডিউল মেনে ট্রেন চালানো এবং যাত্রী হয়রানি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
রোববার রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে (৭৯৩) পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার শিডিউল। তার অনেক আগেই হাজারো যাত্রী স্টেশনের বিভিন্ন স্থানে এসে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু রাত সোয়া ১১টায়ও ট্রেনটি স্টেশনে আসার খবর নেই। অনেকেই স্ক্রিনে ট্রেনটি কোন প্ল্যাটফর্মে এসে থামবে সেটি দেখছিলেন। এ সময় যাত্রীরা স্টেশনের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাচ্ছিলেন, ট্রেন আসার খবর কী। কিন্তু স্টেশন মাস্টার মাহমুদুল হাসান তাদের সঠিক তথ্য দিতে পারছিলেন না। তবে তিনি এই টুকু বলে তাদের আশ্বাস দেন, ঢাকা থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস যখন থেকে চলাচল শুরু হয়েছে তার বেশির ভাগ সময়ই দেখছি, এই ট্রেন শিডিউল মেনে ছেড়ে যেতে পারছে না এবং ঢাকায় আসতেও পারছে না। একপর্যায়ে ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসে। অপরিচ্ছন্ন বগি নিয়েই গন্তব্যের উদ্দেশ ৫০ মিনিট বিলম্বে ছেড়ে যায় এবং ট্রেনটি পরদিন নির্ধারিত সময়ের পৌনে ৪ ঘণ্টা বিলম্বে পঞ্চগড় গিয়ে পৌঁছে বলে জানা যায়। একইভাবে ৬ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে যথাসময়ে পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটি দিনাজপুর স্টেশনে এলেও সেটি নির্ধারিত সময়ের অনেক পর ঢাকায় পৌঁছে। রাত ১১টার পর পৌঁছালেও তার আগে সেখানেও একইভাবে যাত্রীরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
চলন্ত অবস্থায় ট্রেনটি ঘুরে দেখা যায়, ট্রেন যখন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিল তখন একজন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে নাকমুখ বেঁধে যাত্রীদের সিটে বসা অবস্থায় হাল্কা ঝাড়– দিতে দেখা যায়। বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর জিআরপি পুলিশ ‘ঢ’ এবং ট্রেনের সর্বশেষ গার্ডের বগির মধ্যে ফাঁকা স্থানে দু’জন লোককে দেখে কঠোর ভাষায় বলতে থাকেন, যদি এই ট্রেনে কোনো চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তাহলে তোদের লাত্থি মেরে ফেলে দেবো। তোদের খবর আছে কিন্তু। এরপর যাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলে যান, যাত্রীরা যখন ঘুমিয়ে পড়েন তখন এরাই মোবাইল ফোন নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে লাফ দিয়ে চলে যায়। এমন কথা বলার পর আর কোনো পুলিশকেই ওই বগিতে দেখা যায়নি। ট্রেনের যাত্রীরা যখন তাদের প্রয়োজনে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যান তখন তারা দেখতে পান বাথরুমগুলো একেবারেই অব্যবহারযোগ্য। কোনো দরজার আবার হাতল নেই। শীতের রাতে জানালাগুলো আটকানোর কোনো অ্যাটেনডেন্টের দেখা মেলেনি। অনেক জানালার সিটকানি ভালো না, যে কারণে লাগানো যায়নি। এ কারণে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে কোনো কোনো যাত্রীকে যাত্রা করতে হয়। এর মধ্যে মাঝে মধ্যে মাইকে ভেসে আসছিল সম্মানিত যাত্রী মহোদয়, আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের যাত্রা নিরাপদ হোক এই কামনা করছি। ইদানীং ট্রেন স্টপেজে দাঁড়ানো ও স্লো চলার সময় অতর্কিত চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তাই আপনারা আপনাদের মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখবেন এবং জানালার পাশে মোবাইল ব্যবহারে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করবেন। ফজরের আজানের সময় ট্রেনের মাইকগুলোতে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। প্রতি ওয়াক্তের আজান দেয়া এবং কোথায় কোন বগিতে যাত্রীরা নামাজ আদায় করতে পারবেন সেটিও মাইকে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলে দেয়া হচ্ছে। ট্রেনে টিকিটবিহীন যাত্রী উঠলেও তাদের বিরুদ্ধে সেভাবে কঠোর হতে দেখা যায়নি টিটিদের; বরং দেখা গেছে আন্ডারস্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে তাদের খালি থাকা সিটে লোক বসিয়ে গন্তব্য নিয়ে যেতে। ট্রেনটি দিনাজপুর স্টপেজে নামার পর অবশ্য এক যাত্রীর সাথে আরএনবি সদস্যদের কথাকাটাকাটির ঘটনা হয়। পরে যাত্রীর কোলে শিশু থাকায় এ যাত্রায় রেহাই পান ওই যাত্রী।
একই চিত্র ছিল গত সোমবার দুপুরে পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে দিনাজপুর স্টেশনে বেলা ২টা ২২ মিনিটের দিকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনটিতে। এ দিন ‘ঘ’ বগির এসি কামরায় বেশ কিছু সিট খালি ছিল। এ সুযোগে টিকিটবিহীন লোকজন এসে সেগুলোতে বসে থাকতে। এমনও দেখা গেছে, একজন টিটি এসে একজন যাত্রীকে নির্ধারিত একটি আসনে বসিয়ে দিতে। আবার এমনও দেখা গেছে একজন পুলিশকে ওই এসি বগির শেষ সিট থেকে একজন কিশোরীকে বের করে দিতে। এ সময় তিনি বলছিলেন এই কিশোরী পাগল। পাশের বগির যাত্রীদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলছিলেন, এসি বগির সিট কিনলাম, কিন্তু এখন দেখছি এসিই চলছে না। কাকে বলব সেই মানুষটি খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। এই ট্রেনেরও অ্যাটেনডেন্টদের খুব একটা দেখা মেলেনি। তবে ট্রেনে যারা (ক্যাটারিং সার্ভিস) চা, নাশতা ও খাবার বিক্রি করছেন বগিতে তাদের বেশি উৎপাত চোখে পড়ে। তাদের কারণে সাধারণ যাত্রীদের ভ্রমণ ও চলাচলে বিঘœ ঘটতে দেখা যায়। বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকে পানি পাননি। নেই টিস্যু পেপারও।
দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড় স্টেশনে যাওয়ার সময় একাধিক যাত্রী এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের মনের কথা প্রকাশ করে বলার চেষ্টা করেন, সাবেক রেলপথ মন্ত্রী সুজন পঞ্চগড়ের মানুষ ছিলেন। তার সময়ে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলতে কোনো সমস্যা হতো না। সবসময় লাইন ক্লিয়ার থাকত। বগিগুলো থাকত সুন্দর ঝকঝকে। এখন তিনিও নাই, লাইনও ক্লিযার নাই। বগিগুলোও সুন্দর না। বেশির ভাগ ভাঙা বগি দিয়ে এখন এই লাইনে ট্রেন চলছে। সাবেক মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন কোথায়Ñ জানতে চাইলে তারা বলেন, অবৈধ টাকা যেমন কামাইছিল এখন ধরা খাইয়্যা জেলে আছে জানি। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, ঢাকা থেকে পঞ্চগড় অনেক দূরত্ব। দেশের শেষ সীমানা। এখানে শিডিউল মতো যেন ট্রেনগুলো চলে সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে তারা মনে করেন। কারণ রাতে ওঠার পর পরদিন সকাল পেরিয়ে অনেক সময় দুপুর হয়ে যায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে। এর জন্য অনেক সময় ট্রেনের চালকদেরও খামখেয়ালি থাকে। তারা বলেন, ট্রেন চলাচলের সময়েও ইদানীং পরিবর্তন এসেছে বলে শুনেছি। কিন্তু অনেক যাত্রী এ বিষয়টি এখনো জানেন না। যাত্রীদের এটি অবহিত করার ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তারা দাবি করছেন।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন অ.দা.) এ এম সালাহ উদ্দীনের সাথে ট্রেন চলাচলের নতুন সময় ও অপারেশন সম্পর্কিত বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি লাইন কেটে দেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা