চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি সাইফ পাওয়ারের হাতেই থাকছে
- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ কনটেইনার টার্মিনাল—নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পতিত সরকারের সময়ে নিযুক্ত অপারেটরের হাতেই থাকছে আপাতত। বন্দরের বিধি সংশোধনে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নতুন কোনো অপারেটর নিয়োগ দিতে পারছে না বন্দর কতৃর্পক্ষ। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা টার্মিনালটি পতিত সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার প্রক্রিয়াও জোরেশোরে চলছে। যদিও এর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনে নেমেছে। বন্দর ব্যবহারকারীরা টার্মিনালটি বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার যেমন ঘোর বিরোধী, প্রাইভেট মনোপলিও বন্ধ করার পক্ষে। গত প্রায় এক দশক ধরে টার্মিনালটিতে অপারেটর হিসেবে কাজ করছে সাইফ পাওয়ার টেক।
বন্দরসূত্র জানিয়েছে, বিদ্যমান ৪টি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে এনসিটি সবচেয়ে বড় এবং কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অত্যাধুনিক হ্যান্ডলিট যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ টার্মিনাল। বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বন্দরের নিজস্ব তহবিল হতে প্রায় ৫ শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এ টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। ২০০৭ সালে টার্মিনালটি অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হলেও নানা জটিলতায় টার্মিনালটি চালু করতে পারেনি বন্দর কতৃর্পক্ষ। পরবর্তীতে কতৃর্পক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে আরো প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে অত্যাধুনিক সব ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয় টার্মিনালটির জন্য। অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা শর্তের বেড়াজালে ২০১৫ সাল থেকে অনেকটা একতরফাভাবেই টার্মিনালটি পরিচালনা করে আসছে সাইফ পাওয়ার টেক। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্দরের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকতার্দের ম্যানেজ করে ওভার বিলিং—এর কথাও বন্দর সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উক্ত টার্মিনালটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর দ্বারা পরিচালনার সিদ্ধান্ত থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় কোন ইক্যুইপেমন্ট সংগ্রহ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের জন্য বেশ কয়েক বার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও অনিবার্য কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে টার্মিনালটি শুরু হতে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা যায়নি। পরবর্তীতে সরকারি সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিজস্ব অর্থায়নে টার্মিনাল পরিচালনার প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করে ২০১৭ সালে টার্মিনালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হয়।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)—তে ৫টি বার্থ/জেটি রয়েছে। এনসিটি বার্থ—২ ও ৩ এবং এনসিটি বার্থ—৪ ও ৫ এ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং অপারেশন পরিচালনা করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ২ (দুই) বছরের জন্য ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করা হয় এবং উক্ত দরপত্র অনুযায়ী মেসার্স সাইফ পাওয়ারটেক লি. ২০১৭ সাল পর্যন্ত কন্টেইনার হ্যান্ডলিং অপারেশন পরিচালনা করে। এর পর হতেই মূলত সরকারের উচ্চ পর্যায়কে ম্যানেজ করে এমন সব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, যার ফলে সেখানে অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দরপত্রে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল না। ২০১৭ সালে উক্ত দরপত্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দরপত্র দলিল যথাযথ না হওয়ায় তা বাতিল করা হয়। ২০১৯ সালে ওটিএম পদ্ধতিতে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং ২০২০ সালে উক্ত দরপত্রের মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় হতে উক্ত দরপত্রটি ২০২২ সালে বাতিল করে পুনরায় ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সে—মতে ২০২২ সালে পুনরায় ওটিএম—এর মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় হতে ১১—১২—২০২২ তারিখে ৬ (ছয়) মাসের জন্য ডিপিএম—এর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা এবং নীতিমালা পরিবর্তনের নির্দেশনা প্রদান করা হলে চলমান দরপত্র বাতিল করা হয়। ২০১৮ সালে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি পূর্বের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাইফ পাওয়ারটেকের সাথে ডিপিএম—এর মাধ্যমে টার্মিনালের অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
বন্দরসূত্র জানিয়েছে, এনসিটির অপারেশন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা অব্যাহত রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ওটিএম—এর মাধ্যমে নতুনভাবে দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন চেয়ে গত ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কতৃর্ক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়া হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় হতে ৩০ অক্টোবর পিপিএ—২০০৬ ও পিপিআর—২০০৮ এর বিধি—বিধান অনুসরণ করে ওটিএম পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট মেয়াদে অপারেটর নিয়োগের কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়। সূত্র জানায়, ওটিএম পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগসংক্রান্ত রেগুলেশন ফর ওয়ার্কিং অব চিটাগং পোর্ট (কাগোর্ এন্ড কনটেইনার), ২০০১ এর ধারা ৬৮(এ) এবং ৭৪(এ)—এর শর্তসমূহ প্রতিযোগিতামূলক এবং উন্মুক্ত অংশগ্রহণে বাধা তৈরি করে। ফলে গত ১২ নভেম্বর রেগুলেশন সংশোধনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কতৃর্ক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সংশোধন হয়নি। রেগুলেশন সংশোধনে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ২০১৫ সাল থেকে এনসিটি অপারেশনে থেকে একক মনোপলি কায়েম করা সাইফ পাওয়ারটেকের সুযোগকে যেন প্রসারিত করা হয়েছে এমন মন্তব্য বন্দর ব্যবহারকারীদের।
একাধিক বন্দর ব্যবহারকারী নয়াদিগন্তকে জানিয়েছেন, দ্রুত রেগুলেশন সংশোধন করে ৫টি জেটিতে ৫ জন অপারেটর নিয়োগ দেয়া হলে একদিকে কাজের গাতি যেমন বাড়বে, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক দর ব্যবসায়ীদের জন্য সাশ্রয়ী হবে। কমবে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস। একই সাথে হ্যান্ডলিং তথ্য ইনপুটের ক্ষেত্রে যাতে ম্যানিপুলেট করা না যায় সেজন্য কঠোর নজরদারির ওপরও গুরুত্ব দেন ব্যবহারকারীরা।
উল্লেখ্য, এনসিটির বর্তমান টার্মিনাল অপারেটরের সাথে চুক্তির মেয়াদ আজ ৭ জানুয়ারি শেষ হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কতৃর্পক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক এ বিষয়ে নয়াদিগন্তকে জানিয়েছেন, ডিপিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করতে বন্দরের বিদ্যমান বিধিমালা সংশোধন এখন পর্যন্ত না হওয়ায় আপাতত বিদ্যমান অপারেটরই টার্মিনাল অপারেট করবে। বিধিমালা সংশোধন হলে এরপর প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে নতুন অপারেটর নিয়োগ দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা