মা-বাবাকে চিঠি লিখে শহীদি মিছিলে নাম লেখায় আনাস
- বাসস
- ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৬
‘স্বপ্নে দেখি, চোখ বন্ধ করলেই দেখি, আনাস দাঁড়ায়া আছে। ঘুমাতে পারি না। আজকে পাঁচটা মাস হতে চললো, আমরা চোখের পাতা এক করতে পারি না...মনে হয় এইতো আমার যাদু মণি’।
এ কথাগুলো শহীদ আনাসের পিতা সাহরিয়া খান পলাশের। তিনি ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিষণœ কণ্ঠে এসব বলছিলেন।
‘দুয়ার ভেঙে যে ছেলেটি মিছিলে গেছে,
তারে তুমি ফিরায়ো না আর।
মাগো তারে তুমি পেছন হতে ডাকিও না আর।’
কবির এই কবিতাটির সাক্ষাৎ উপমা দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া আলোচিত শহীদ আনাস। পুরো নাম শাহারিয়ার খান আনাস। বয়স ১৭ বছর।
এই কিশোরকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিল পরিবার। তাই কাউকে কিছু না বলে গোপনে বাবা-মা’কে উদ্দেশ করে চিঠি লিখে রেখে মিছিলে চলে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শহীদি মিছিলে নাম লেখান।
চিঠিতে আনাস লিখেছিলেন, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না।
আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম কোরে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেনো বোসে থাকবো ঘরে...।’ বাবা-মায়ের হাত থেকে সেই চিঠি এখন ১৮ কোটি মানুষের হাতে হাতে। যে চিঠিটা কাঁদিয়েছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানবিক মানুষকে।
চিঠির শেষে তিনি লেখেন, ‘একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বোসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেয়। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সেই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।-আনাস।’
সানজিদা খান দীপ্তি (৩৬) এবং সাহরিয়া খান পলাশ (৪২) দম্পতির বড় ছেলে শহিদ আনাস। ছোট ছোট দুইটা ভাই তার। সাফওয়ান (৫) প্লে গ্রুপে এবং সুফিয়ান (২) মায়ের কোলে। সাফওয়ান খেলার সাথী বড় ভাইকে খুব মিস করে। আর সুফিয়ান আনাসকে ‘আনা’ বলে ডাকতো। তাই এলাকার দেওয়ালের ছবিগুলো যখন দেখে, তখন ‘আনা আনা’ বলে ডেকে ওঠে।
গেণ্ডারিয়া আদর্শ একাডেমীর বিজ্ঞান বিভাগের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন আনাস। শাহারিয়ার খান নামটি ছিল মূলত তার বাবার। কিন্তু ভুলক্রমে তার বাবার নাম সাহরিয়া খান লেখা হয়ে যায় এবং নাম চেঞ্জ করা অনেক ঝামেলা বলে বাবা তার ছেলের নাম রেখে দেন নিজের নামে ‘শাহরিয়ার খান’।
আন্দোলনে স্বৈরাচারের নৃশংসতার কারণে বাবা-মা কোনভাবেই তাকে বের হতে দিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর তাকে ধরেও রাখতে পারলেন না। গত ৫ আগস্ট সকালে আনাস সবার অগোচরে তুলা, ব্যান্ডেজ, স্যাভলন, ক্লোফেনেল জেল, পভিসেপ, ট্রাউজার-গেঞ্জি ইত্যাদি ব্যাগে ভরে প্রস্তুতি নিয়েই বের হয়েছিলেন।
সেই ভয়াল দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আনাসের পিতা পলাশ বলেন, ‘আমার মামাতো ভাই মেহেরুফ সাড়ে ৯টার দিকে ওকে কোতোয়ালি থানা থেকে বের হতে দেখে। চাচাকে দেখে ও দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাঁতিবাজারে ওর সাথে দেখা হয় মুন্সীগঞ্জ জেলা শিবিরের সভাপতি মুজাহিদ ও আ. রহমানের সাথে। তখন সে মুজাহিদকে প্রশ্ন করে, ‘ভাইয়া তোমরা কি আন্দোলনে যাচ্ছো? আমাকেও তোমাদের সাথে নাও না।’
তিনি আরো বলেন, এভাবে দলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আনাস চাঁনখারপুল পর্যন্ত চলে যায়। গেণ্ডারিয়া থেকে চানখাঁরপুল প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার, পুরো রাস্তা সে হেঁটে হেঁটে গেছে। তারপরে চানখাঁরপুলের বার্ন হাসপাতালের ঠিক উল্টো পাশে ওদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। প্রথমে ওর গায়ে ছররা গুলি লাগে।
তারপরে ওরা গলির ভেতরে ঢুকে যায়। ওই যে ভিডিও দেখেছেন না, শুয়ে-বসে এপিবিএন সদস্যরা গুলি করছিল। যাদের তখন অফিসাররা বাহবা দিচ্ছিল, তাদেরই একটি গুলি ওর প্রাণ কেড়ে নেয়।’
শোকে কাতর আনাসের মা বলেন, ওকে কখনো বকা দিলে ও মাথা নিচু করে রাখতো। এত ভদ্র ছিল আমার ছেলেটা। কোনো কারণে অপরাধ করলেও কখনো মিথ্যা কথা বলে নাই। জানে মাইর খাবে, তারপরও বলে নাই।
ছোটবেলায় মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলাম। কান্নাকাটি করত। তাই এক বছর পরে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। খুব দায়িত্ববান ছিল। সকালে নাস্তা এনে সবাইকে খাওয়াইতো। আমি রুটি বানাতে পারতাম না। তাই সকালে হোটেল থেকে রুটি কিনে আনাতাম। টিফিনের জন্য ২০ টাকা দিতাম। সে ওইখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে মাত্র একটা বিস্কুট আর পানি খেয়ে থাকত। সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত পড়ত। কখনো মুখ ফুটে বলত না যে, আমার ক্ষুধা লেগেছে। খুব বেশি ক্ষুধা লাগলে শুধু বলত, ‘ তোমরা খাবা না?’ খাওয়ার পরে থাল বাসনগুলো পর্যন্ত নিজে ধুয়ে রাখত, যাতে আমার কষ্ট কমে।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার যাদুটা নিয়মিত নামাজ পড়তো এবং নামাজ শেষে আমাদের সাথে নিয়ে একসাথে দোয়া করত। মাঝে মাঝে এত লম্বা দোয়া করত, আমরা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যেতাম।’
যে ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা পর্যন্ত কোনো দিন খায়নি, সেই ছেলের এরকম মৃত্যুতে এলাকাবাসীও কেঁদেছে।
ওর লাশ নিয়ে এলাকার মানুষ মিছিল করেছে। মহল্লায় স্বৈরাচারের দোসরদের একটি ক্লাব ঘর ছিল। ক্ষুব্ধ মানুষ ক্লাব ঘরটি ভেঙে ফেলেছে।
পলাশ বলেন, আমাদের নিকেতনের সড়কটির নাম ছিল ‘দিননাথ সড়ক’। সবাই মিলে ভালোবেসে তাদের ছোট আনাসের জন্য সড়কটির নাম পাল্টিয়ে রেখেছে ‘শহীদ আনাস সড়ক’। নিকেতনের সভাপতি আলতাফ হোসেন হজ থেকে এহরামের কাপড় নিয়ে এসেছিলেন। সেই কাপড় তিনি আনাসের জন্য দিয়ে দেন এবং এহরামের কাপড় দিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়।’
আনাসের পিতা বলেন, ‘জুরাইন কবরস্থানে আমরা যখন ওকে দাফন করতে যাই, তখন ফরম ফিলাপ করতে বলা হয়। সে ফরমে মৃত্যুর কারণ লিখতে হয়। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, এটা লিখবে না। তারা বলে, লেখেন এক্সিডেন্টে বা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। আমরা বললাম, ‘কেন আমরা এটা লিখব’? এই হলো ফ্যাসিবাদের অবস্থা! তারা কবরস্থান কর্তৃপক্ষকে পর্যন্ত বলে দিয়েছে, কোনোভাবেই যেন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু লেখা না হয়। ঘটনার দিন তো আর ডেথ সার্টিফিকেট নেয়ার সময় পাইনি। ছেলের লাশ দেখে কি আর মাথা ঠিক ছিল? তারপরে সাত তারিখে আমরা ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। কিন্তু কেউ দিতে চায় না।
ছোটখাটো ব্যবসা করতেন আনাসের পিতা। করোনার সময় লকডাউনের পরে ব্যবসার মন্দায় এক প্রকার বেকার ছিলেন। এই ঘটনার পরে ফ্রান্স প্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য সরাসরি তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পরিবারের দায়িত্ব নেন। তিনি পরে তার এক বন্ধুর গুলশানের হেড অফিসে আনাসের পিতাকে পাঠান। পিনাকীর সুপারিশে একটা বেসরকারি গ্রুপ অব কোম্পানিতে আনাসের পিতার চাকরি হয়। ওখান থেকে ২০ হাজার টাকা মাসে পান। তা দিয়েই তাদের দিন চলে যাচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওর নানা বাদি হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ২৫ জনের নামে মামলা করেছেন। এর মধ্যে চারজন আছেন একদম প্রত্যক্ষদর্শী।
সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকে টাকা দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি কারো টাকা গ্রহণ করিনি। আমি শুধু জামায়াতে ইসলামের এক লাখ, খোকা ফাউন্ডেশনের এক লাখ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা গ্রহণ করেছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা