বিরোধী দলের নেতাকর্মীতে ঠাসা ছিল ৬৮ কারাগার
জেল পালানোও ছিল আলোচিত ঘটনা : আইজি প্রিজন্স- মনির হোসেন
- ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫১
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটিসহ দেশের ৬৮টি কারাগার বিগত বছরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীতে ঠাসা ছিল। বন্দীদের বেশির ভাগই ছিল বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বা সমর্থক। এ সময়টায় কোনো কোনা কারাগারে ধারণ ক্ষমতার ৫ থেকে ৮ গুণ বন্দীও অবস্থান করছিল। জেল জীবনে একদিকে যেমন তাদের ছিল ঘুমানোর কষ্ট, অপর দিকে ছিল খাওয়ার কষ্ট। এক কথায় অনেকেরই জীবন ছিল দুর্বিষহ। আর এ সবই ছিল বিদায়ী বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগের চিত্র।
এর আগে আটক কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নাশকতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জঙ্গি ও গায়েবি মামলা দিয়ে ফেরারি আসামি বানানো হয়েছিল। আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে তারা জামিন তো পাননি, উল্টো তাদেরকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদি সাজা। এসব মামলায় অনেকে পলাতক জীবন কাটিয়ে উপায় না পেয়ে একপর্যায়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর মধ্যেও অনেকে মিথ্যা মামলায় সাজা খেটে কারাগার থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময় কারাগার থেকে বের হতেও বাধা ছিল। কারাগার থেকে বের হলেও অনেককে কিছ ুদুর যাওয়ার পর আবার পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আবারো শুরু হয় তাদের জেলজীবন।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিহ্নিত অফিসারদের ইচ্ছাতেই দায়ের হওয়া ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ মামলায় বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে মাসের পর মাস কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাতে হয়েছিল। শুধু কারাগারে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিল তা কিন্তু নয়, নানা অজুহাতে বন্দীদের সাথে স্বজনের দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের সেই জেল জুলুম আর নির্যাতনের অবসান ঘটে। এ সময়ে ঢাকা বিভাগসহ দেশের ১৭টি কারাগার থেকে বন্দী পালানোর ঘটনাও ঘটে। গুলিতে মারা যায় নিরীহ বন্দী। আহত হয়েছিলেন কারারক্ষীরাও।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৫ আগস্ট। এ দিন দুপুরের দিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা গণরোষ থেকে বাঁচতে গণভবন থেকে ভারতে পালিয়ে যান। এর পরই দেশের পরিস্থিতির সাথে সাথে পাল্টাতে থাকে কারাগারগুলোর চিত্রও। মিথ্যা মামলায় আটক বন্দীরা আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেতে থাকেন। এখনো বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকর্মী ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় কারাগারে আটক আছেন। তারাও যেকোনো দিন জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে আসবেন বলে কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দীদের কেউ কেউ বলছেন, ২০২৪ সালে যা ঘটেছে সেটা অলৌকিক ঘটনা। নিয়তির কি খেলা তা এখন দেখতে পাচ্ছি। বর্তমানে কারাগারগুলোতে আটক আছেন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রভাবশালী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, প্রধানন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ অর্ধশতাধিক মন্ত্রী, এমপি, পুলিশের সাবেক আইজি, আমলা এবং নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপের সহযোগী যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অংগসংগঠনের নেতা-কর্মী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের কারাগারগুলোতে আগে যেভাবে কারারক্ষী ও কর্মকর্তা নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য ও বন্দী বেচাকেনা করে কোটি কোটি টাকা কামাই করা হতো, সেই সব দুর্নাম ঘোচানোর চেষ্টা করছেন বর্তমান আইজি প্রিজন্স। এর পরও কারাগারে আওয়ামী লীগের গুণগান গাওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা থেকে নিম্ন পর্যায়ের কারারক্ষীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে নানা কৌশলে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করছেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো: মোতাহের হোসেনের কাছে ২০২৪ সালে কারাগারের অবস্থা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল গত সপ্তাহে। তিনি নয়া দিগন্তকে ২০২৪ সালের আলোচিত ঘটনার মধ্যে জেলব্রেকের ঘটনাটিকে সবচেয়ে আলোচিত বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত (২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে) ব্যাপক হারে বন্দী পালানোর ঘটনা কোনো কারাগারে ঘটেনি। গত বছরের ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারের প্রধান গেট ভেঙে একযোগে সব বন্দী পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু নরসিংদী নয়, শেরপুরসহ মোট ১৭টি কারাগার থেকেই বন্দী পালানোর ঘটনা ঘটে। এ সময় ৮ জন বন্দী গুলিতে নিহত এবং ৮০ জন বন্দী আহত হয়েছিলেন। একই সময় বাধা দিতে গিয়ে ২১১ জন কারারক্ষী আহত হয়েছিলেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে আইজি প্রিজন্স বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এসব ঘটনায় কাদের বেশি গাফিলতি ছিল সেগুলোর প্রতিটি তদন্ত করে দেখা হয়েছে। ওই সময় কারাগার থেকে বন্দী পালানোর পর দেশের আন্দোলনের গতিবিধিও পরিবর্তন হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তখন যে টাইপের থ্রেট ছিল সেগুলো আমরা তদন্তে চিহ্নিত করেছি। আমরা এগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে সামনের দিনে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে জন্য সবাইকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সাজাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যে কারা প্রশাসন ঢেলে সাজানানোর চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের দিয়ে কারাগারগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছি। কারাগারের অবকাঠামো, ইকুইপমেন্ট ও সিকিউরিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আমি যোগদান করার পর ঢাকা এবং কাশিমপুরের কারাগারগুলোতে বিদ্যমান পরিবর্তন এনেছি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হচ্ছে মাদকপ্রবণ এলাকা। আস্তে আস্তে এসব কারাগারগুলোতেও নজর দিচ্ছি। নিরাপত্তা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন, আমি বাস্তববাদী লোক। এখানে নানা মতের কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্বে আছেন। আমি হুট করেই সব কিছুর পরিবর্তন আনতে পারবো না। সময় লাগবে। তবে আগে যা হয়েছে সেটি আর চলতে দেবো না। অনিয়ম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবো না। তবে কারাগারগুলোতে এখনো যে অব্যবস্থাপনাগুলো রয়েছে সেগুলো বর্তমান আইন, বিধি আর ব্যবস্থাপনা দিয়ে করাটা সম্ভব না। জনবলেরও অভাব রয়েছে বলে জানান তিনি।
গতকাল কারা বিশ্লেষক ও সাবেক ডিআইজি প্রিজন্স মেজর (অব:) সামছুল হায়দার সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, কারাগারে আগে যেভাবে অনিয়ম হতো সেগুলো অনেকটাই বর্তমান আইজি প্রিজন্স এসে বন্ধ করার চেষ্টা করছেন বলে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। তার মতে, যারা (বন্দী-কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী) কারাগারে এখনো ঘাপটি মেরে আছেন, তাদের বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে। পাশাপাশি বন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহারও করতে হবে। বিশেষ করে বন্দীরা যাতে প্রকৃত অর্থেই কারাগার থেকে সংশোধন হয়ে বের হতে পারেন, সে দিকে কর্তৃপক্ষের নজর বেশি দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।