০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ পৌষ ১৪৩১, ৫ রজব ১৪৪৬
`
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

জেগে ওঠা আলোকবর্তিকা

সালতামামি
-


ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা আলোকবর্তিকায় রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত বছর ১ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। এর মাত্র চারদিন পরই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপরই দেশে ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে জামায়াত। নিষিদ্ধ থাকা অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতি থেকে সেনাপ্রধান সবার সাথে বৈঠকে অংশ নেন জামায়াতের আমিরসহ শীর্ষ নেতারা। দেশের সঙ্কট সমাধানে তাদেরকে ত্রাতার ভূমিকায় দেখা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে জামায়াতকে গুরুত্বের সাথে আহ্বান জানানো হয়। আর নিষিদ্ধের মাত্র ২৭ দিন পরই উঠে যায় বিধিনিষেধ। হাসিনা সরকারের দেয়া জামায়াতকে নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা সামাজিক কাজ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে দেশে এখন এক আলোচিত দলের নাম জামায়াতে ইসলামী। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র চলছে জামায়াত বন্দনা। হঠাৎই যেন বড় দলে রূপান্তরিত হয়েছে জামায়াত। অনেকেই মনে করছেন বিগত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল কারিগর ছিল জামায়াত-ছাত্রশিবির। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পেছনে থেকে শক্তি জুগিয়েছে দলটি। এজন্য আগামী নির্বাচনে বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো করবে জামায়াতে ইসলামী। এমনকি আগামীর নির্বাচিত সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তিও মনে করা হচ্ছে জামায়াতকে। তাদের এ উত্থানকে যেন ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায়ই শুধু ফেরেনি জামায়াত; ক্রমেই যেন আলোকবর্তিকায় (আলো প্রদানকারী) রূপান্তরিত হয়েছে দলটি।

জামায়াত-সূত্রে জানা যায়, বিগত আওয়ামী শাসনামলে তাদেরকে ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। শীর্ষ পাঁচ নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কয়েকজন শীর্ষ নেতা জেলখানায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনো কয়েকজন জেলখানায় রয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমান আমির, সেক্রেটারি থেকে শীর্ষ সব নেতাকেই একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী জেলখানায় বছরের পর বছর নির্যাতিত হয়েছেন। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে এক দিনেই প্রায় দুইশ নেতাকর্মীকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে অনেক নেতাকর্মীকে গুম-খুন করা হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগের লোকেরা বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। এমনকি বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মীকে নির্যাতন করে চোখ অন্ধ করে দেয়া হয়েছে, থানায় নিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। রিমান্ডের নামে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। ২০১৩ সালে বাতিল করে দেয়া হয় জামায়াতের নিবন্ধন। দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও কেড়ে নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় অফিসসহ সারা দেশের সব অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শেষ দিকে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট দলটিকে রাজনীতি থেকেই নিষিদ্ধ করে দেয় আওয়ামী সরকার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী সরকার সবদিক থেকেই জামায়াতের ওপর ঝঁাঁপিয়ে পড়েছিল। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর এবং মঈন-ফখরুদ্দিনের আগের দুই বছর মিলিয়ে সাড়ে ১৭ বছর ধরেই আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালানো হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসসহ সারা দেশের অফিসগুলো গায়ের জোরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি আমাদের ঘরেও থাকতে দেয়া হয়নি। অনেক জায়গায় আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় তারা বুলডোজারও ব্যবহার করেছে। এর পাশাপাশি আমাদের নিবন্ধন অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মাসের পর মাস রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রবিরোধী অনেক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। সেই সময় যেভাবেই হোক একটি সরকার ছিল, পাশাপাশি আরেকটি সরকারের কথায় জাতীয় পতাকা উঠতো এবং নামতো। এ ধরনের এখতিয়ার আইনগতভাবে তাদের ছিল না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলতেন ‘আমার শরীরটা পড়ে থাকে সংসদে আর মন পড়ে থাকে শাহবাগে’। এভাবে তাদের উসকানি দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জেলে পুরা হয়েছে। এমনি শিশুদেরকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বৃদ্ধদেরও ছাড় দেয়া হয়নি। বিপুল সংখ্যক সহকর্মীকে, জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ খুন করা হয়েছে। অনেককে পঙ্গু করা হয়েছে। অনেককে গুম করা হয়েছে। আর বিচারের নামে যে প্রহসন করা হয়েছে, তামাশা করা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ এবং বিশ^ পর্যালোচনা করেছে।

জামায়াত আমির বলেন, বিগত সাড়ে ১৭ বছরে আমাদের অনেক দুঃখ-কষ্টে গেছে। আমরা একে একে আমাদের ১১ জন শীর্ষস্থানীয় দায়িত্বশীলকে হারিয়েছি। পঁাঁচ শতাধিক সহকর্মীকে আমরা জুলাই বিপ্লবের আগেই হারিয়েছি। জুলাই বিপ্লবের সময়ও আমরা বহু সহকর্মীকে হারিয়েছি। ছাত্রশিবির হওয়া সেই সময় মহাপাপের মতো তুলে ধরতো। এমনি মিডিয়াগুলোও বলতো শিবির সন্দেহে মারপিট-আটক। শিবিরতো তখন কোন নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল না। সরাসরি বলতে পারতো শিবিরের কর্মী বা শিবিরের নেতা। এটা না বলে বলতো শিবির সন্দেহে। এভাবে সারা দেশে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এমনি ছাত্রী মেয়েদের সাথেও তারা দুর্ব্যবহার করতো, পিরোজপুরের ঘটনা তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ। সেই অবস্থা থেকে ৫ আগস্টের এ মহাপরিবর্তনের মাধ্যমে শুধু আমাদের নয়, গোটা জাতিকেই আল্লাহ তায়ালা মুক্তি দিয়েছেন। এজন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আর এ মুক্তির জন্য শহীদদের রক্ত, পঙ্গু-আহত ভাইবোনসহ সবার ত্যাগ কুরবানিকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা এখন কিছুটা স্বস্তির সাথে কার্যক্রম চালাতে পারছি। মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য নিয়ে যেতে পারছি। এজন্য আল্লাহর তায়ালার প্রতি শুকরিয়া। আর দেশবাসীর জন্যও আমাদের শুভকামনা যে দেশবাসীও আমাদের সেভাবে গ্রহণ করেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement