০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ পৌষ ১৪৩১, ৫ রজব ১৪৪৬
`
বৈষম্যবিরোধী বীরত্বগাথা

একটি বুলেট কেড়ে নিলো শহীদ নাঈমের পরিবারের স্বপ্ন

-


দিনটি ছিল গত বছরের ৪ আগস্ট। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নে বিকেলে ঢাকার বাইপালের আশুলিয়ায় বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিক নাঈম বাবু (১৮)। সে দিনের একটি বুলেট কেড়ে নেয় তার প্রাণ। সেইসাথে ভেঙে যায় পরিবারের সব স্বপ্ন।
পরিবারের পরিকল্পনা ছিল কিছুটা সচ্ছলতা ফিরলেই নাঈমকে বিয়ে দেয়ার। এরপর সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির কাছে স্থায়ী একটি সেলাইয়ের (দর্জি) দোকান দেয়ার। সে আয়ে পরিবারে ফিরবে সচ্ছলতা। এজন্য জমিয়েছিলেন ২৬ হাজার টাকা। সে টাকায় কিনেছিলেন একটি গরু। আর কিছুটা টাকা জমলেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোবেন তিনি। এ জন্য সময় নিয়েছিলেন এক বছর। কিন্তু একটি বুলেটের আঘাতে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পরিবারটির। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রণচণ্ডী ইউনিয়নের সোনাকুড়ি গ্রামে শহীদ নাঈম বাবুর বাড়ি। আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন মামা আনিছুর রহমান (৪০) ও মামি রোখসানা বেগমের (৩৫) পরিবারে।

গত ৪ আগস্ট পোশাক কারখানার ছুটির পর বিকেলে কয়েক বন্ধু মিলে বৈষম্যবিরোধী মিছিলে অংশ নেন নাঈম বাবু। এরপর পেটে গুলি লাগলে তাকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ আগস্ট রাত ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে বাড়িতে তার লাশ এসে পৌঁছলে আসরের নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তার মামী রোখসানা বেগম জানান, ছয় বছর বয়সে মারা যায় নাঈমের বাবা মো: মোস্তফা। এর দুই বছর পর মা হাছনা বানুর অন্যত্র বিয়ে হয়। এক বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে নাঈম সবার ছোট। বড়বোন নাজমিনের (২৮) বিয়ে হয়েছে তার বাবার মৃত্যুর আগে। জীবিকার তাগিদে বড়ভাই নাজমুল ইসলাম (২৪) চট্টগ্রামে এবং মেজোভাই আব্দুল হাকিম থাকেন ঢাকায়।

জন্মের পরেই নাঈমকে নিয়ে তার বাবা মাসহ আসেন এখানে। এরপর ছোট নাইমকে মামির কাছে রেখে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় চলে যান তারা (বাবা-মা)। নাঈমের ছয় বছর বয়সে তার বাবার মৃত্যু হয়। এর দুই বছর পর মা হাছনা বানুকে অন্যত্র বিয়ে দেয় পরিবার। পরের সংসারে তার মায়ের চার বছরের এক কন্যাসন্তান রয়েছে।
মামী রোখসানা বেগম বলেন, জন্মের পর থেকে আমি তাকে লালন-পালন করেছি সন্তানের মতো করে। আমার দুই সন্তানের সাথে তাকে আমি বড় সন্তান মনে করতাম। সেও ধরে নিয়েছিল এটিই তার পরিবার। আমাদেরকে মামা-মামী ডাকলেও বাবা-মায়ের মতোই মনে করত। আমার দুই সন্তানকেও নিজের ছোট ভাই মনে করে দেখাশোনা করত। তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে আয় রোজগার করে দুই ছোটভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করবে। কিন্তু সে সাধ আর পূরণ হলো না তার।
গ্রামের একটি হাফেজিয়া মাদরাসায় মোহতামিম হিসেবে কাজ করেন নাঈমের মামা। মামী বাড়িতে কাজ করেন দর্জির। তাদের সামান্য আয়ে অভাব অনটনে চলত সংসার। এমন কষ্টের সংসারে নাঈম লেখাপড়া করেছেন চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত। পরে একটি মাদরাসায় কুরআন হেফজ করেন ১৫ পারা। শেষে সংসারের অভাব দূর করতেই ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন তিনি।

মামা আনিছুর রহমান জানান, এক বছর পর বাড়িতে নতুন একটা ঘর তুলে বিয়ে দেয়ার কথা ছিল নাঈমের। এরপর সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির কাছে তার মামীসহ একটি দর্জির (সেলাই) দোকান দেয়ার কথা ছিল। এ জন্য নাঈম টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যায়। সেখানে প্রতি মাসে যে আয় হতো নিজের খরচের পর কিছুটা সঞ্চয় এবং কিছু টাকা মামা-মামীর খরচের জন্য পাঠিয়ে দিত। তার সঞ্চয়ের টাকায় বাড়িতে পালনের জন্য ২৬ হাজার টাকায় একটি গরু কেনা হয়। আর কিছু টাকা জমলেই বাড়িতে চলে আসার কথা ছিল নাঈমের। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে একটি বুলেটের আঘাত সব তছনছ করে দিয়েছে। সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে নাঈম।
পারিবারিক সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতর এবং একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিছু অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা হয়েছে পরিবারকে। নাঈমের চিকিৎসার সময়ে বিভিন্ন ধারদেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে এখন পরিবারটিকে।

 


আরো সংবাদ



premium cement