প্রচণ্ড শীতে জবুথবু মানুষ
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০৫
পৌষ মাসের মাঝামাঝিতে প্রচণ্ড শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। তাপমাত্রা কম থাকায় কনকনে শীত জেঁকে বসেছে। ধোঁয়াটে কুয়াশা আর হাড় কাঁপানো উত্তরা বাতাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
গতকাল দিনের পুরো সময় সূর্যের দেখা মিলেনি। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য কিরণ আসতে পারছে না। আবার কয়েকদিন থেকে সকালে ঘন কুয়াশা থাকায় মাটিসহ অন্যান্য বস্তু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ফলে সূর্যতাপ না থাকায় তাপমাত্রা আরো কিছুটা নিচের দিকে চলে গেছে। সূর্যতাপে উষ্ণতা পেয়ে অভ্যস্ত মানুষ হঠাৎ কম তাপে অনেকটা ঘরবন্দী, হঠাৎ এত শীতে বেহাল অবস্থা। একান্ত বাধ্য না হলে গতকাল ঘরের বাইরে কমই বের হয়েছেন। গতকাল দুপুরের দিকে ঢাকা শহরে যানবাহনের সংখ্যাও কম ছিল। শহরের চেয়ে গ্রামে শীতের তীব্রতা আরো বেশি। শীতের অনুভূতি সেখানে সুই বিঁধানোর মতো। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, সারা দেশে এত শীত, কিন্তু কোথাও শৈত্যপ্রবাহ নেই। তবে গত রাতেই (গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) নিম্ন তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস ছিল। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত রাতে তাপমাত্রা কিছু বাড়লেও দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়ে উষ্ণতা বাড়াবে এবং মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তিরভাব ফিরে আসতে পারে যদিও সারা দেশেই কুয়াশা আগের মতোই থাকার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি শীতে এটাই ছিল ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
কুয়াশা অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় রাতের চলাচলেও হঠাৎ করে ছন্দপতন ঘটেছে। সামান্য দূরের বস্তুও দেখা যায় না বলে রাতের দুর্ঘটনার হারও হঠাৎ বেড়েছে। যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যাদের এখন দূরের গন্তব্যে যেতে হয়, তারা রাতে নয়, দিনের বেলা গাড়িতে উঠছেন, যাতে দুর্ঘটনার কবলে পড়তে না হয়। স্থলভাগের দিকে কুয়াশা একটু কম হলেও নদী তীরবর্তী স্থানে অথবা জলাশয় রয়েছে এমন স্থানে ভারী কুয়াশা পড়ছে।
সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল দেশের প্রায় সর্বত্র মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশার ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে রাস্তায় চলাচল করতে যানবাহনগুলোকে হেড লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়েছে। দুপুরের দিকে দেশের কোথাও কোথাও হালকাভাবে বৃষ্টির মতো ঝরেছে কুয়াশা। শীতের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি শীতে গতকালই সবচেয়ে বেশি গরম জামাকাপড় পরে বাইরে বের হতে হয়েছে। তাপরও রাজধানীতে এমন অসংখ্য মানুষকে খুবই স্বল্প কাপড় পরে ঘুরতে দেখা গেছে। কারণ একটি গ্রুপের মানুষের কাছে গরম কাপড় কেনার অর্থ নেই। রাজধানীতে এদেরই একটি অংশ এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাস্তায় রাত কাটাতে বাধ্য হয়।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী রোববার পর্যন্ত রাত ও দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশে স্বস্তি ফিরে আসতে পারে কিন্তু এর পরদিনই অর্থাৎ আগামী সোমবার থেকে দেশের কোনো কোনো স্থানে হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। এর পরদিন থেকেই অর্থাৎ আগামী ৭ ডিসেম্বর থেকে আবারো শীত পড়তে শুরু করতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। উত্তরের হিমেল বাতাসের কারণে ঠাণ্ডা যেন জেঁকে বসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক দিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমেছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ৯৫ শতাংশ।
চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, গতকাল সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তিনি জানান, হাড় কাঁপানো বাতাস ও ঘন কুয়াশার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাপমাত্রা আরো হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর থেকে শীতল বাতাস বইছে। রাতের তাপমাত্রাও হ্রাস পাচ্ছে।
এ দিকে শীত উপেক্ষা করে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে। হাটবাজারের শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কাজের সন্ধানে শহরে এসে অনেকে কাজ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। শীত উপেক্ষা করে রিকশাভ্যান নিয়ে শহরে এসে পর্যাপ্ত যাত্রী পাচ্ছেন না চালকেরা।
জেলা সদরের সরোজগঞ্জের দিনমজুর সোহাগ মিয়া বলেন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজের জন্য চুয়াডাঙ্গা শহরে আসতে হয়। এত শীতে সাইকেল চালিয়ে শহরে পৌঁছানো কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। হাত অবস হয়ে পড়ে। শীতে কাজও তেমন একটা নেই। মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সেই জন্য কাজও পাচ্ছি না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ট্রাকচালক জাকির হোসেন জানান, এ এলাকায় চরম শীত পড়েছে। কুয়াশাও রয়েছে আকাশে। কুয়াশার কারণে গাড়ি চালানো কষ্ট হয়ে পড়েছে। হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী রানা মিয়া বলেন, শীতের জন্য মানুষ কম চলাচল করছে বাইরে। হোটেল খোলা থাকলেও বিক্রি নেই। যাদের প্রয়োজন তারাই বাজারে আসছেন। শীতের তীব্রতা অনেক বেশি দিনে ও রাতে।
খানসামা (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, উত্তরের জেলা দিনাজপুরের খানসামায় ক্রমেই কমছে রাতের তাপমাত্রা। তিন দিন ধরে দেখা মিলছে না সূর্যের। রাতের হিমশীতল ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে এ জেলায় শীতের তীব্রতা বেশি বিরাজ করছে। তবে গত কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘন কুয়াশা না থাকলেও রাতে বেড়েছে শীতের প্রকোপ।
গতকাল সকাল ৬টায় ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে দিনাজপুর আবহাওয়া অফিস। এর আগে গত মঙ্গলবার এ জেলায় দেশের তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সরেজমিন গতকাল সকালে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কুয়াশা না থাকলেও বইছে হিম বাতাস। আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। হিমেল হাওয়ায় কনকনে শীতে সাধারণ মানুষ কাহিল হয়ে পড়েছে। শীতের কারণে জরুরি কাজ ছাড়া মানুষ বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। তবে পরিবারের চাহিদা মেটাতে অনেকেই শীত উপেক্ষা করেই কাজের সন্ধানে ছুটছেন। অপর দিকে তীব্র শীতে অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে ব্যস্ততম সড়ক ও হাটবাজারগুলো। দিনের বেলা সূর্যের দেখা না মিললেও ঠাণ্ডা বিরাজমান, কাজে যাচ্ছেন না অনেকেই। ভোরে হালকা কুয়াশা থাকার কারণে বিভিন্ন সড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহানগুলোকে চলাচল করতে দেখা গেছে। এ দিকে শীতের কারণে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা।
ভ্যানচালক মিজানুর রহমান বলেন, এত সকালে বের হয়ে কোনো লাভ নেই। এমনিতে যে ঠাণ্ডা বের হতে মন চায় না। সকালে লোকজনও কম। তাই ইনকামও কম। দিনমজুর শাহিনুর ইসলাম বলেন, সকালে একদম কাজে যেতে মন চায় না, দুই দিন ধরে সূর্যই উঠে না। কি যে এক জ্বালায় আছি।
কৃষক আব্দুল মতিন জানান, রসুন লাগিয়েছি। কয়েক দিন আগে দিনের তাপে পুড়ে যেতে ধরেছিল। এখন রোদ না থাকায় কিছুটা স্বস্তিতে আছি। দেখা যাক কি হয়। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী নূর আমিন বলেন, দিনে গরম রাতে ঠাণ্ডা এই অবস্থায় জ্বরে ভুগছি। সেই সাথে সর্দি, কাশি ও গলাব্যথা তো আছেই। এই আবহাওয়ায় চরম বিপাকে আছি।
দিনাজপুরের আবহাওয়া অফিসের অফিসার ইনচার্জ মো: তোফাজ্জল হোসেন বলেন, চার দিন ধরে দেখা মিলছে না সূর্যের সেই সাথে হিমেল হাওয়া। জেলায় বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯২% এবং গত ২৪ ঘণ্টায় বাতাসের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, মধ্য পৌষে জেঁকে বসেছে শীত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামেও বেড়েছে শীতের তীব্রতা। প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। আবহাওয়া অফিস বলছে, শীতের এমন তীব্রতা থাকবে আরো ৪ থেকে ৫ দিন।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় শীতের অনুভূতি তীব্র হচ্ছে। ৭ জানুয়ারির পর তাপমাত্রা বাড়তে পারে। শীতের তীব্রতা থাকলেও চট্টগ্রামে শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাধারণত তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এলে শৈত্যপ্রবাহ হয়ে থাকে। কিন্তু চট্টগ্রামে এমন পরিস্থিতির সম্ভাবনা কম।
এ দিকে শীত ও কুয়াশার দাপটে অসহায় অবস্থায় পড়েছে দিনে এনে দিনে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষেরা। তাদের রুজি-রোজগার কমে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে অনেকেরই কাজকর্ম জুটছে না। শীত থেকে রক্ষা পেতে অনেকে আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নেয়ার চেষ্টা করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনের বেশির ভাগ সময়ই চট্টগ্রামে সূর্যের দেখা মেলেনি।
শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগও। আক্রান্ত হচ্ছেন সব বয়সী মানুষ। বিশেষ করে শিশু রোগীর সংখ্যাই বেশি। সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসা শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতের প্রকোপে বেড়েছে শিশু রোগীর সংখ্যা। চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, গত দুই কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে শিশু রোগী ভর্তির সংখ্যা শয্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যাদের বেশির ভাগেরই বয়স একদিন থেকে চার বছর পর্যন্ত। এ ছাড়া অনেকেই বাসায় থেকেই রোগের চিকিৎসা নিচ্ছে। বাকলিয়া থানাধীন বলাকা আবাসিক এলাকার গৃহবধূ সাবরিনা সুলতানা জানান, আমার ৩টা বাচ্ছাই ছোট। বড়টার বয়স ৫ বছর ছোটটার বয়স ৪ মাস। ঘরে রোদ না ঢোকায় বাসার ভেতরেও প্রচুর ঠাণ্ডা। সন্তানদেরকে শীতের কাপড় পরিয়ে রেখেও সর্দি-কাশি ঠেকানো যাচ্ছে না। অনলাইনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শিশুদের ওষুধ খাওয়াচ্ছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা