০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ পৌষ ১৪৩১, ৩ রজব ১৪৪৬
`

ব্যাংক খাত তছনছ করে বিদায় ফ্যাসিবাদের

- ছবি : নয়া দিগন্ত

সরকারি খাতে ভালো ব্যাংক হিসেবে উদাহরণ দেয়া হতো বেসিক ব্যাংককে। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে লুটপাটের মাধ্যমে এখন রুগ্ণ হিসেবে পরিণত হয়েছে ব্যাংকটি। সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক বের করে নেয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে এস আলম বেক্সিমকো, এনন টেক্স নামক অখ্যাত কোম্পানি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয় ঋণের নামে। শুধু রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকই নয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ফোকলা করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। এক ডজন ভালো মানের বেসরকারি ব্যাংক এখন দুর্বল ব্যাংকের খাতায় নাম লিখিয়েছে। অনেক ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। সেই সাথে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ কার্যক্রম ভেঙে গেছে। এসব ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, কিন্তু তা আর ফেরৎ দেয়া হচ্ছে না। একমাত্র পি কে হালদারই রিলায়েন্সসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর গ্রাহরেক অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এভাবে গত দেড় দশকে দেশের ব্যাংকিং খাত তছনছ করা হয়েছে। এসব অর্থের বেশির ভাগই পাচার করে দেয়া হয়েছে। এস আলম, সামিট গ্রুপের আজিজ খানসহ অনেকেই দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশের নাগরিক হয়েছেন। ব্যাংকিং খাতের তহবিল লোপাট ও তা পাচার করে দিয়ে অবশেষে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের বিদায় হয়েছে।

এস আলমে শেষ ৮ ব্যাংক : ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি ব্যাংকে ১০ শতাংশের বেশি মালিকানায় থাকতে পারবে না। ব্যাংকগুলোর পরিবারতন্ত্র প্রতিরোধে এ বিধান করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই ২০০৯ সালের পর এসব বিধান একের পর এক পাল্টাতে থাকে। দেড় দশকের ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাত সুরক্ষার সব বিধানই ভেঙ্গে ফেলা হয়। দেশের আর্থিক খাতের অভিশাপ বলে খ্যাত ও মাফিয়া এস আলমকে দিয়ে একের পর এক ব্যাংক দখল করতে থাকে। ২০১৭ সালে প্রথমেই দেশের উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে হাত দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এমডিকে তুলে নিয়ে জোর করে ব্যাংকটির মালিকানায় এস আলমের নামে নিয়ে নেয়া হয়। এরপর একের পর এক পানির মতো টাকা বের করতে থাকে। এক সময় উদ্বৃত্ত তহবিলের কারণে ইসলামী ব্যাংক বেকায়দায় পরে যেত। বছরের শেষ মাসে আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করা হতো। কিন্তু সেই ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ঋণের নামে লোপাট করার পর ব্যাংকটির আর্থিকভিত্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। নামে-বেনামে ঋণের অর্থ বের করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এখন ব্যাংকটির তহবিল ঘাটতির মুখে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ইসলামী ব্যাংকের পর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল-আরাফা ব্যাংক ও সর্বশেষ ন্যাশনাল ব্যাংক দখলে নেয় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফা ব্যাংক বাদে অন্য ব্যাংকগুলোর নজুক অবস্থা চলছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে। নতুন পর্ষদের সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

আব্দুল হাই বাচ্চুতে শেষ বেসিক ব্যাংক : এক সময় বেসরকারি খাতের উদাহারণ ব্যাংক ছিল বেসিক ব্যাংক। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছে ভালো ব্যাংক হিসেবে উদাহরণ দেয়া হতো। কিন্তু সেই বেসিক ব্যাংকে চেয়ারম্যান হিসেবে বসানো হয় পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় আব্দুল হাই বাচ্চুকে। আর বাচ্চু বেসিক ব্যাংকে চেয়ারম্যান হয়েই হরিলুট শুরু করেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে বেসিক ব্যাংককে তহবিল শূন্য করা হয়। ঋণের নামে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়াল ঘেঁষা বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লুট করা হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কিছুই করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা যখন বেসিক ব্যাংকের তহবিল লোপাটের তথ্য উৎঘাটন করল তখন সব শেষ হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। কিন্তু বিপরীতে রুগ্ণ ব্যাংকের খাতায় নাম লেখায় বেসিক ব্যাংক। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাটের প্রধান সুবিধাভোগীদের বের করে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। আব্দুল হাই বাচ্চু বর্তমানে বিদেশে পলাতক রয়েছেন।
সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি : হলমার্ক নামক একটি অখ্যাত কোম্পানি সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নেয়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এমডি জেলে রয়েছেন। কিন্তু ওই সময়ের সুভাস সিংহসহ যারা পর্ষদে ছিলেন তাদের আজো আইনের আওতায় আনা হয়নি। অথচ নিরপরাধ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে।

জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি : সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপ, এনন টেক্স, থার্মেক্সসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারি হয়। কিন্তু এসব ঘটনা প্রকাশিত হলেও এস আলম, বেক্সিম, ওরিয়ন গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা বের হয়নি। পরে ৫ আগস্টের একের পর এক ঘটনা বের হতে থাকে। এ পর্যন্ত জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক কোটি টাকা বের করে নিয়ে ব্যাংকটিকে একটি রুগ্ণ ব্যাংকে পরিণত করেছে। এসব অর্থের বেশির ভাগই পাচার করে দেয়া হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে। এভাবে ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংকও ফোকলা করা হয়েছে।
অন্য দিকে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে। পি কে হালদার একাই চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। বর্তমানে পি কে হালদার ভারতের জেলে আটক রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন তহবিল ভেঙে খাচ্ছে। তারা গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।

দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশী পাসপোর্ট ধারণ : গত দেড় দশকে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মন্ত্রী-আমলাসহ দলীয় নেতাকর্মী ও সমার্থক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দেশের ব্যাংকিং খাত তছনছ করে অর্থ পাচার করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। পাশাপাশি দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বিদেশে পাসপোর্টধারী হয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় ডাকাত বলে খ্যাত এস আলম এখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে সিঙ্গাপুরসহ একাধিক দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান বাবু যুক্তরাজ্যে তিন শতাধিক বাড়ির মালিক হয়েছেন। সামিট গ্রুপের আজিজ খানও এখন সিঙ্গাপুরসহ একাধিক দেশের নাগরিক হয়েছেন। এভাবে দেশকে খালি করা হয়েছে। অবশেষে গত ৫ আগস্টের পর ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়েছেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তার সাথে সাথে ব্যাংক ডাকাতরাও রাতের অন্ধকারে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
হাসিনাকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে যা বলল ভারত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ কারওয়ান বাজার এলাকার শীর্ষ চাঁদাবাজ রাসেল জমাদ্দার গ্রেফতার ঢাকার হ্যাটট্রিক হার, খুলনার দ্বিতীয় জয় খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে ‘বিভ্রান্তিকর’ প্রতিবেদন খতমে নবুওয়ত না মানলে ঈমান থাকবে না : মুফতি সাইফুল ইসলাম শেষ নবীর খোঁজে জনকল্যাণমূলক সরকার গঠনে দেশ উপকৃত হবে : জামায়াত আমির রাঙ্গামাটির বন্দুকভাঙ্গা রেঞ্জে ইউপিডিএফের ২ ক্যাম্পের সন্ধান খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার লাদাখের ভূখণ্ড নিয়ে ২ নতুন প্রদেশ চীনের, তীব্র প্রতিবাদ ভারতের

সকল