শিক্ষার্থীদের পরিকল্পনা অভিভাবকদের অনুপ্রেরণায় জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান
সালতামামি- শাহেদ মতিউর রহমান
- ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৬
শুধু ২০২৪ সাল নয়, ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। দীর্ঘ দেড়যুগ জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে রাজনৈতিক দলগুলো যখন বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েও ব্যর্থ হচ্ছিল, ঠিক তখনই ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের একটি ঐক্যবদ্ধ গণ-প্রতিরোধের মাধ্যমেই বিদায় নিয়েছেন শেখ হাসিনা।
অবশ্য শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের চাপিয়ে দেয়া বিতর্কিত কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ছিল চরম অসন্তোষ। ক্লাসরুমে ডিমভাজি আর আলুভর্তা শেখানোর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন অভিভাবক ছাড়াও অনেক শিক্ষক। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে এসব সমালোচনা করার সাহস যেন সবাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও ফেসবুকে কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নামমাত্র কেউ প্রতিবাদ করেছেন বা সমালোচনার চেষ্টা করেছেন তাদেরকেও চিহ্নিত করে মামলা দেয়া হয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছেন কেউ কেউ। সূত্রমতে এখনো অনেক অভিভাবক এসব মামলা জটিলতায় রয়েছেন।
অন্য দিকে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক হলেও তাদের বিরুদ্ধেই সরকার নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। ২০২৪-এর জুলাইয়ের শুরু থেকে রাজপথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবানল ধীরে ধীরে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একসময়ে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ঐকমত্য হয়ে কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন আরো বেগবান করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের তির্যক ও আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে সারা দেশেই শিক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবক ও শিক্ষকরাও আন্দোলনে সহমত পোষণ করেন। কোটাপ্রথার আন্দোলন একসময়ে রূপ নেয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে। ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের ব্যাপকতা দেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এবং আন্দোলন সংগ্রামের গতিপথ নির্ধারণের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় সমন্বয়কদের। এ সমন্বয়করাই মূলত আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে তাদের জীবন বাজি রেখে সামনে থেকে লড়াই করেছেন। সমন্বয়করা সরকারের রোষানলে পড়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে আগস্টের ৫ তারিখ চূড়ান্তভাবে ছাত্র-জনতার বিজয়ও নিশ্চিত হয়েছে।
বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল
ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমেই ঘোষণা দেন যে, আওয়ামী আমলের বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল করা হবে। এমনকি নবম শ্রেণীর বিভাগ বিভাজন তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তও তারা বাতিল ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ অভিভাবক যারা সন্তানের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তারা যেন হালে পানি ফিরে পেলেন। বছর শেষের বার্ষিক পরীক্ষার পদ্ধতিও পরিবর্তন করে আগের নিয়মে মূল্যায়ন করা হয়েছে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার্থীদের। এবার ২০২৫ সালে যেসব শিক্ষার্থী দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে তারা নবম শ্রেণীতে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ না পেলেও এখন সেই সুযোগ পাবে। আর দশম শ্রেণীতে মাত্র এক বছর পড়েই তারা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
২০১২ সালের কাারিকুলামে পাঠ্যবই
এ দিকে বিতর্কিত নতুন কারিকুলাম বাতিল করার পর সরকারের সিদ্ধান্তে এখন ২০২৫ সালের পাঠ্যবই ফিরে গেছে ২০১২ সালের কারিকুলামে। অবশ্য পুরনো কারিকুলামে পাঠ্যবই মুদ্রণে বেশ বেগও পেতে হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবিকে)। স্বল্প সময়ে কারিকুলাম পরিবর্তন করতে গিয়ে পাঠ্যবই মুদ্রণের দরপত্রও পুনরায় আহ্বান করতে হয়েছে। এমনকি আগে যেখানে ৫ থেকে ৬ মাস সময় পাওয়া যেত বই ছাপার কাজের জন্য এবার অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই সেই বই মাত্র এক মাসের মধ্যে ছাপতে হচ্ছে প্রেস মালিকদের। তারপরও এবার পাঠ্যবইয়ের মান আগের যেকোনো বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে দাবি করছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা। বিশেষ করে এবার কাগজের মান, ছাপার উজ্জ্বল্যতা ও ব্রাস্টিং বা পৃষ্ঠার পুরুত্বও অনেক বেশি।
আন্দোলনে অভিভাবকদের সমর্থন
২০২৪-এর জুলাইয়ের প্রথম থেকে শুরু হওয়া ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের প্রতিটি স্তরেই ছিল অভিভাবকদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ আন্দোলেন অনেক ছাত্র গ্রেফতার হওয়ার পরেও তাদের মায়েরা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে; বরং সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডকাপ পরা তার সন্তানের পিঠ চাপড়িয়ে অভয় দিয়ে সাহস জুগিয়েছেন।
রাস্তায় ছিলেন শিক্ষকরাও
ছাত্ররা যখন রাজপথে আন্দোলনে ব্যস্ত ঠিক সে সময় শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করতে রাজপথে নেমে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও। সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরাও সরকার পতনের আন্দোলনে একসাথে মাঠে নেমে আসেন, যা সরকার পতনের আন্দোলনকে আরো গতি দিয়েছিল।
পিছিয়ে ছিল না ছাত্রীরা
শুধু ছাত্র আর শিক্ষকরাই নন, এবারের গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রীরাও। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা ছিল অভাবনীয়। এ আন্দোলনে যারা সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতো।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা