গণহত্যার মামলায় হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ট্রাইব্যুনালের
সালতামামি- হাবিবুর রহমান
- ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৩
বিদায়ী বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৬ বছরে সংঘটিত গুমের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
কার্যক্রমের শুরুতে গত ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এরপর গত ১৭ ডিসেম্বর জুলাই-আগস্টে গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আরো দুই মাস সময় দেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি শেখ হাসিনার বিষয়ে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে দুই সপ্তাহের মধ্যে অগ্রগতি জানানোর নির্দেশ দেন। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
এ দিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত দ্রুত চলছে বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে পৃথকভাবে করা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত আগামী তিন মাসের মধ্যে শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা যাবে বলে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা থেকে জানানো হয়েছে। আর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর মূল বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
শেখ হাসিনার বিষয়ে তদন্ত খুব জোরেশোরে চলছে জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা হয়েছে সেগুলো চলমান থাকবে। তবে তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আছে বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা এবং গত ১৬ বছরের যত গুম, ক্রসফায়ারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ, পিলখানা ও হেফাজতে ইসলামের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের কাছে এসেছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত চলমান আছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ২০১০ সালে এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। গত ৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালে অন্যান্য প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়। পুনর্গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাও।
গত ১৪ অক্টোবর বিচারক নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্টের বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীকে ওই ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা ছিল সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানের করা হয়। এ দিকে সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অপর একটি মামলার আসামি করা হয়েছে।
গুমের অভিযোগ : গত ১৬ বছরে গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৪৪টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলেও প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনা সরকারের আমলে গুমের অভিযোগ তদন্ত চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ১০ দিন গুম করে রাখার অভিযোগ এনে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে এ অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী এনামুল কবির। গুমের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালে কয়েক ধাপে গুম হওয়া ছাত্রশিবিরের ১৯ জন অভিযোগ দায়ের করেন। গত ১৭ নভেম্বর ছাত্রশিবিরের সাত নেতাকে গুম করে নির্মম নির্যাতন এবং গুলি করে চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রেখে পঙ্গু করার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়। জানা গেছে, গুমের ঘটনায় এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) জিয়াউল আহসান, র্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড : ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতাধিক কর্মী হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গত ২৬ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ দায়েরের পর হেফাজতের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, হেফাজতের সমাবেশের পরে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- আমরা নাকি রঙ মেখে সেখানে বসা ছিলাম। এ ছাড়া তিনি সংসদে আরো বলেছিলেন, সমাবেশ ভণ্ডুল করতে এক লাখ ৫৪ হাজার গুলি চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, আপনারাই চিন্তা করেন এত গুলি চালানোর পর কত হতাহত হতে পারে। আন্তর্জাতিক অনেক মিডিয়ায় ট্রাকে লাশ নিয়ে যাচ্ছে এমন ভিডিও ফুটেজ এসেছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও দেখানো হয়েছে।
পিলখানায় হত্যাকাণ্ড : রাজধানীর পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিয়োগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শহীদ সেনাসদস্যদের পরিবারের পক্ষ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গত ১৯ ডিসেম্বর আইনজীবী এস এম তাসমিরুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর এ অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগ দায়ের করার পর আইনজীবী তাসমিরুল ইসলাম জানান, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা হত্যার সাথে আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার সামঞ্জস্যতা পেয়েছি। শেখ হাসিনা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সঙ্কটের মুখে ফেলার জন্য এবং তার স্বৈরশাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বৃহৎ এবং শক্তিশালী বাহিনীকে ধ্বংস করতে এই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা