চলমান কাজে মেরামতসহ ২ খাতে সরকারের ক্ষতি ৬২ কোটি টাকা
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে দুর্নীতি- ইদ্রিস মাদ্রাজী
- ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩০
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সেতু বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে চলমান প্রকল্পের নির্মাণাধীন কাজে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা, চুক্তির শর্ত উপেক্ষা করে আপ্যায়ন খরচ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬২ কোটি টাকা। এই অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার এ- অডিটর জেনারেলের কার্যালয় থেকে অডিট সম্পাদন করা হয়েছে। অডিট আপত্তি অনুসারে চিহ্নিহ্নত অনিয়মের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রস্তুত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু উদঘাটিত দুর্নীতির এই ফাইল সেতু ভবনে চাপা পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। দুর্নীতির ফলে সরকারের এই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে পরামর্শ দেয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
তথ্যসূত্র জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে চলমান প্রকল্পের নির্মাণকালীন কাজে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করে দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৮,৭৭,৪১,৪৪০ টাকা। এক্ষেত্রে, নিরীক্ষাকালে প্রকল্পের নির্মাণকাজের চুক্তির দলিল, নকশা, আইপিসি ও পেমেন্ট ডকুমেন্টস পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্যাকেজ নম্বর ডব্লিউডি ১ এর আওতায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে মাল্টি লেন সড়ক টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ চায়না কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের সাথে ৭০৫,৮০০,০০০ মার্কিন ডলার মূল্যের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির অধীন আইটেম নম্বর ০১১৮-০০২ তে নির্মাণ চলাকালীন মেরামত কাজে লামসাম পরিমাণের ভিত্তিতে ৪৮,৭৭,৪১,৪৪০ টাকা (৪৪,৭৪,৬৯২.১১ মার্কিন ডলার) নির্ধারিত ছিল।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে সেকশন ১ এর (চুক্তি মূল্যকে ১৩টি কস্ট সেন্টারে বিভক্ত করে সাব আইটেমের মাধ্যমে বিল পরিশোধ) অধীন টানেল নির্মাণকাজের সাধারণ ফ্যাসিলিটিস আইটেম নম্বর ০১১৮-০০২ তে নির্মাণ চলাকালীন মেরামতের কাজ দেখিয়ে আইপিসি নম্বর ৩৭ এর মাধ্যমে ঠিকাদারকে ৪৮,৭৭,৪১,৪৪০ টাকা (৪৪,৭৪,৬৯২.১১ মার্কিন ডলার দ্ধ ১০৯ টাকা) চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করা হয়। চুক্তির ক্লজ নম্বর ১.১.৬.১০ (চুক্তির আওতায় প্রকল্প কাজের পরিধি অনুযায়ী এট গ্রেড রাস্তা টানেলের মূল অংশ নির্মাণ (ভায়াডাক্ট, ওপেন কাট, কাট অ্যান্ড কাভার, ভেন্টিলেটর স্যাফ্ট), সংযোগ সড়ক, ক্রস পাসেজ, টোল প্লাজা এবং সংলগ্ন ভবনসহ নির্মাণকাজ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উপরোক্ত আইটেমের প্রতিটি কাজ নতুন করে করতে হবে।
এ প্রকল্পে মেরামতযোগ্য কোন পুরাতন কাজ না থাকায় নির্মাণ চলাকালীন মেরামত কাজ দেখানোর সুযোগ নেই। চুক্তির পিসিসি ক্লজ নম্বর ১.১.৩.৭ অনুযায়ী কাজ সমাপ্তির পর ৭৩০ দিন পর্যন্ত নির্মাণ ঠিকাদার নির্মাণসংক্রান্ত ক্রটি নিজ অর্থায়নে সংশোধন করবেন। ৭৩০ দিন পর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ টানেলে যাবতীয় মেরামত ও সংরক্ষণ করবে।
আলোচ্য চুক্তিটি EPC- Turnke পদ্ধতিতে সম্পাদিত হওয়ায় Negotiation এর মাধ্যমে চুক্তি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। Negotiation পর্যায় উক্ত আইটেম বাদ না দিয়ে ঠিকাদারকে নির্মাণকালীন কাজের মেরামত/রক্ষণাবেক্ষণ দেখিয়ে ৪৮,৭৭,৪১,৪৪০.০০ টাকা বিল পরিশোধ করায় সরকারি অর্থের ক্ষতি হয়েছে।
নির্মাণ কাজের defect liability period রয়েছে। সুতরাং চুক্তির এ শর্তের অধীন নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে কোনো ক্রটি দেখা দিলে ঠিকাদার নিজ অর্থায়নে উক্ত ক্রটি মেরামত করবে। তাই নতুন নির্মাণ প্রকল্প হওয়ায় চুক্তিতে ঠিকাদারের অন্যায্য সুবিধা প্রদান করার জন্য নতুন কাজের মেরামত দেখিয়ে অর্থ পরিশোধ করা হয়। চুক্তিতে দেখানো মেরামতের সপক্ষে কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। এতে চুক্তির পিসিসি ক্লজ নম্বর ১.১.৩.৭ এর লঙ্ঘন করা হয়েছে।
যদিও টানেল প্রকল্পটি নিজেই নতুন ছিল তবে নির্মাণের সময়, ঠিকাদারকে বিদ্যমান ট্র্যাফিকের প্রবাহ বজায় রাখতে এবং ডাইভারশন রুট তৈরি করতে হয়েছিল। রোড জিআই এবং জি২ এ জাতীয় ডাইভারশনের অংশ ছিল এবং ঠিকাদার টানেল নির্মাণের সময় ট্র্যাফিক প্রবাহের জন্য তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল। কস্ট সেন্টারের আইটেম নম্বর ০১১৮-০০২ শুধু এ ধরনের খরচ বোঝায়। যাই হোক, এ টানেল নির্মাণ চুক্তি একটি Lum sum Turnkey চুক্তি যেখানে ঠিকাদার Variation order ব্যতীত সর্বাধিক ঝুঁঁকি গ্রহণ করে। চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত কস্ট সেন্টারগুলো নেগোশিয়েশনের সময় এবং প্রক্কলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুক্তির দলিলে প্রদত্ত ব্যয় কস্ট সেন্টার কোনও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইটেমের ইউনিট রেট প্রাপ্ত করা ছাড়া অন্য কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।
নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানের জবাবে অডিট বিভাগ বরেছে, তদের জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ, অস্থায়ী ডাইভারশন রোডটি কস্ট সেন্টার নম্বর ২ (অস্থায়ী কাজ), আইটেম নম্বর ০২১২-০০০ অস্থায়ী রাস্তা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ডেমোলিশন বাবদ ১৫,৬২,৬৮,৭২২.০০ টাকা (১৪,৩৩,৬৫৮.০০ মার্কিন ডলার) এবং রোড ফ্যসিলিটিসি আইটেম নম্বর ০৯২০ ( রিভার, রোড এবং অন্যান্য মেরামত) বাবদ ৫,৪৪,৬২,৯৪০.০০ টাকা (৪৯৯৬৬০.০০ মার্কিন ডলার) পরিশোধ করা হয়েছে। তাই নতুন টানেল নির্মাণের ক্ষেত্রে মেরামতের কাজ প্রাসঙ্গিক ছিল না। এ ব্যাপারে নিরীক্ষার সুপারিশে বলা হয়, দায়ী ব্যক্তির নিকট থেকে আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করা আবশ্যক।
আপ্যায়ন খরচ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ
সূত্র জানায়, চুক্তির শর্ত উপেক্ষা করে আপ্যায়ন খরচ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় ১৩,৯৮,৩৩,২২৪ (তেরো কোটি আটানব্বই লক্ষ তেত্রিশ হাজার দুইশত চব্বিশ) টাকা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
নিরীক্ষাকালে প্রকল্পের নির্মাণ কাজের চুক্তির দলিল, আইপিসি ও পেমেন্ট ডকুমেন্টস পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালের ৩০ জুন M/S China Communication company Ltd. সাথে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে মাল্টি লেন রোড টানেল নির্মাণের চুক্তির আওতায় আইটেম নম্বর ১২১২-০০০তে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে আপ্যায়নের ১৩,৯৮,৩৩,২২৪ টাকা (ইউএসডি ১২,৮২,৮৭৩.৬২ দ্ধ১০৯ টাকা) নির্ধারিত ছিল।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত চুক্তির সেকশন ১, আইটেম নম্বর ১২১২-০০০ অধীন আইপিসি নম্বর ৩৭ এর মাধ্যমে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে আপ্যায়ন বাবদ ১৩,৯৮,৩৩,২২৪.০০ টাকা (ইউএসডি ১২,৮২,৮৭৩.৬২ দ্ধ ১০৯ টাকা) প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে আপ্যায়নের জন্য চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করে চূড়ান্ত পরিশোধ করে। চুক্তির ক্লজ নম্বর ১.১৩ অনুসারে নিয়োগকর্তার প্রয়োজনীয়তা (Employer’s Requirements) অনুযায়ী প্রকল্প কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে দরপত্রের মাধ্যমে প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে আপ্যয়ন ব্যয়ের বিল পরিশোধ করবেন। চুক্তির আইটেমের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ দেখানো হলেও উক্ত ব্যয়ের সপক্ষে দরপত্র, বিল-ভাউচার, প্রকৃত খরচের প্রমাণক পাওয়া যায়নি। প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিল সুপারিশকারী হিসাবে এবং বিল প্রদানকারীর যোগসাজশের মাধ্যমে অর্থ খরচ না হওয়া সত্ত্বেও অর্থ খরচ দেখানো হয়েছে । সুতরাং চুক্তির শর্ত উপেক্ষা করে আপ্যায়ন খরচ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় ১৩,৯৮,৩৩,২২৪ টাকা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ অনিয়মের কারণে চুক্তির ক্লজ নম্বর ১.১৩ লঙ্ঘন।
এ ব্যাপারে নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানের জবাবে নিরীক্ষা বিভাগ বলেছে, তাদের জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ, চুক্তির শর্ত অনুসারে আপ্যায়ন ব্যয় আইটেম হতে অর্থ খরচের আগে ঠিকাদারকে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের (নিয়োগকর্তা) অনুমতি নিতে হবে এবং প্রকৃত ব্যয় বিল-ভাউচারসহ হিসাব প্রদান করতে হবে, যা অনুসরণ করা হয়নি। এ ক্ষেত্রেও দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে আপত্তিকৃত অর্থ অবশ্যই আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা