আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর খোলা চিঠি
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২৪
রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
গতকাল দেশবাসীর উদ্দেশে এক খোলা চিঠিতে তিনি এ ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আমি পঞ্চম বিএমএ (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) লং কোর্সের অফিসার হিসেবে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করি। আমি কখনো আত্মপ্রচার পছন্দ করি না। কিন্তু এখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে একান্ত নিরুপায় হয়েই দেশবাসীর কাছে কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই।
কমিশনপ্রাপ্তির সময় সর্ব বিষয়ে সেরা চৌকস ক্যাডেট হিসেবে আমি ‘সোর্ড অব অনার’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি পরীক্ষায় কলা বিভাগ থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘স্বর্ণপদক’ এবং রণকৌশলে সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য আমি ‘ট্যাকটিক্স প্ল্যাক’ অর্জন করি। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সচিত্র মুখপত্র ‘সেনানী’ এর জানুয়ারি ১৯৮২ সংখ্যার ৭ ও ৮ নম্বর পৃষ্ঠায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের ৮ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা আছে, ‘তিনি (প্রেসিডেন্ট এরশাদ) সামরিক একাডেমির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মেধায় উত্তীর্ণ সেরা চৌকস ক্যাডেট ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে সম্মাসূচক তরবারি ও স্বর্ণপদক প্রদান করেন।’ আমার জানা মতে বিএমএর ইতিহাস কেউ এই রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। কমিশন পরবর্তী অধিকাংশ কোর্সেই প্রথম স্থান অধিকার করেছি। কেবলমাত্র মেডিক্যালজনিত কারণে ২-৩টিতে প্রথম স্থান অর্জন করতে পারিনি। কমান্ড, স্টাফ এবং ইনস্ট্রাক্টর সব ধরনের দায়িত্বে আমি সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হই। মাস্টার্স পরীক্ষায় (৭০.৫ নম্বর পেয়ে) প্রথম শ্রেণীতে ২য় এবং এম.ফিল (প্রথম পর্বে) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছি। সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করায় এমফিল সম্পূর্ণ করতে পারিনি। মহান আল্লাহর দয়ায় এবং বাবা-মা এর দোয়ায় প্রায় ৩০ বছরের সামরিক জীবনে একজন আদর্শ সেনা অফিসার হিসেবে এবং পাশাপাশি একজন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অফিসার হিসেবে আমি সবার জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যেকোনো অফিসারই এক বাক্যে আমার এই বক্তব্যের সপক্ষে সাক্ষ্য দিবে।
তিনি আরো বলেন, আমার কৃতিত্বপূর্ণ এই চাকরির পরও ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন আমার মেজর থেকে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি বন্ধ করে রেখেছিল। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে আমার লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি হয়। পরবর্তীতে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পাই।
২০০৯ সালে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে। আমি তখন দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার অন্তর্গত খোলাহাটি ক্যান্টনমেন্টে ১৬ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার এবং পাশাপাশি স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। জুন মাসে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ অত্যন্ত অপমানজনকভাবে আমাকে আমার পদ থেকে অপসারণ করে পদবিহীন অবস্থায় ঢাকা সেনানিবাসের সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়ায় সংযুক্ত করে রাখেন। এরপর, ২০০৯ সালের ২৩ জুন এক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০০৯ সালের ২৪ জুন আমাকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে নজিরবিহীনভাবে ‘বরখাস্ত’ করা হয়। এই আদেশের দ্বারা আমার অবসরের আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সব সুবিধাদি থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়। বিনা অপরাধে, বিনা অভিযোগে, বিনা তদন্তে ও বিনাবিচারে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তো দূরের কথা একজন সৈনিককেও বরখাস্ত করার কথা নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার কোনো নজির আছে বলে জানা নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, গণমাধ্যমের এক শ্রেণীর দায়িত্বজ্ঞানহীন অংশ ‘আমি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে’ মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই বক্তব্য মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমি এই ধরনের হলুদ সাংবাদিকতার তীব্র নিন্দা জানাই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আমি শিগগিরই যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার ইচ্ছা রাখি। সেনাসদর (আইএসপিআর) কর্তৃক এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট রিপোর্ট গণমাধ্যমে পাঠিয়ে জাতির কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করবে বলে আমি আশা রাখি। বলা বাহুল্য, আমি নিজে সেনাসদরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি।
তিনি বলেন, বরখাস্ত পরবর্তী সাত বছর দুই মাস (অপহরণের পূর্ব পর্যন্ত) আমাকে গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিচালক/ কনসালট্যান্টের দায়িত্ব পালন করছিলাম। সব কর্তৃপক্ষকে সরকার চাপ দিয়ে আমাকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট আমাকে আমার বাসা থেকে অপহরণ করে ডিজিএফআই সদর দফতর, কচুক্ষেতে অবস্থিত তথাকথিত ‘আয়নাঘর’ এ ২৯০৮ দিন (৬৯,৭৯৪ ঘণ্টা) আটক রেখে আমার ওপর সীমাহীন মানসিক নির্যাতন করা হয়। ৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লবের মাধ্যমে (যা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত) দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হলে সেই রাতেই আমাকে ঢাকা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। ৭ আগস্ট ২০২৪ রাত আনুমানিক ১১:৪৫ মিনিটে যমুনা ব্রিজের কাছে এলেঙ্গা নামক স্থানে আমাকে রাস্তার পাশে নামিয়ে দেয়া হলে আমি বাসে করে ৮ আগস্ট ভোরে আমার বাসায় ফিরে আসি। আমার এই বিবৃতির মূল উদ্দেশ্য শিরোনামে লেখা আছে। প্রসঙ্গক্রমে কিছু কথা বলতে হলো।
আমান আযমী বলেন, ২০০৯ সালের ২৪ জুন আমাকে বরখাস্ত করা ন্যক্কারজনক আদেশ বাতিল করে গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ এক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা সেনাসদর থেকে ২৬ ডিসেম্বর আমাকে অবহিত করা হয়। একই প্রজ্ঞাপনের দ্বারা ২৪ জুন ২০০৯ তারিখ হতে আমাকে অকালীন বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করে আমার অবসরের আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সব সুবিধাদি প্রদান করা হয়। আমার ওপর যেই সীমাহীন জুলুম করা হয়েছে তার কোনো আর্থিক বা অন্য কোনো প্রতিদান কোনো দিনও সম্ভব নয়। আমার বৃদ্ধা, বিধবা ও অসুস্থ অসহায় মা প্রায় তিন বছর আমার শোকে কাঁদতে কাঁদতে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। পৃথিবীর সব সম্পদ দিয়েও কি আমার মাকে ফিরিয়ে আনা যাবে? যা হোক, বিলম্বে হলেও আমার অবসরের এই আদেশ আমার ওপর যে সীমাহীন নির্যাতন ফ্যাসিবাদী সরকার করেছে তার প্রতিদানের একটি অংশ (যতটুকুই হোক) হিসেবে বিবেচ্য। আমার বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে আমাকে অবসর প্রদানের এই আদেশ প্রদানের জন্য আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে আমার এবং আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এর জন্য মহান আল্লাহ্ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন এই দোয়া করি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা