হত্যাকারী আকাশ মণ্ডল ৭ দিনের রিমান্ডে
- চাঁদপুর ও কুমিল্লা প্রতিনিধি
- ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডারের ঘটনায় আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীতে সারবহনকারী এমভি আল বাখেরা জাহাজে সাতজনকে একাই হত্যা করেন আকাশ। গ্রেফতার আকাশ মণ্ডল ইরফান (২৬) বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট এলাকার জগদীশ মণ্ডলের ছেলে।
গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক ফারহান সাদিক এ বিষয়ে আদেশ দেন। গত সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেলে হাইমচর নীলকমল ইউনিয়নে মেঘনা নদীর মাঝেরচর এলাকায় সারবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখেরা থেকে মাস্টার ও সুকানিসহ সাতজনের লাশ উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশ। এ সময় গুরুতর জখম অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করা হয়।
গত মঙ্গলবার সাতজনের মৃত্যুর ঘটনায় চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানায় মামলা করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা ডাকাত দলকে আসামি করে মামলাটি করেছেন জাহাজের মালিক মাহবুব মুর্শেদ। জিআর ১৬৬/২৪ মামলা তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) নৌপুলিশের পরিদর্শক মো: কালাম খান নয়া দিগন্তকে জানান, আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে গতকাল আদালতে উপস্থাপন করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। বিচারক সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
এজাহারের বরাত দিয়ে নৌপুলিশের পরিদর্শক মো: কালাম খান জানান, জুয়েলের গলাকাটা থাকায় সে কথা বলতে পারেনি। ঘটনার বিবরণ দিতে পারেনি। সে সুস্থ হলে ডাকাত দল দেখলে চিনবে বলে ইশারায় জানায়। তবে জুয়েলের সাথে ইরফান নামে আরেকজন ছিল বলে সে লিখে জানায়। তবে তার ঠিকানা দিতে পারেনি। ঘটনার পর ওই জাহাজে একটি রক্তাক্ত চাইনিজ কুঠার, একটি ফোল্ডিং চাকু, দু’টি স্মার্টফোন, দু’টি বাটন ফোন, একটি মানিব্যাগ, নগদ আট হাজার টাকা, একটি বাংলা খাতা, একটি সিল, একটি হেডফোন জব্দ করেছে পুলিশ।
নিহতরা হলেন- জাহাজের মাস্টার ফরিদপুরের মো: গোলাম কিবরিয়া (৬৫), তার ভাগিনা জাহাজের লস্কর শেখ সবুজ (৩৫), জাহাজের সুকানি নড়াইলের লোহাগড়ার আমিনুল মুন্সী (৪০), জাহাজের লস্কর মাগুরার মোহাম্মদপুর এলাকার মো: মাজেদুল ইসলাম (১৭), একই এলাকার লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬), জাহাজের ইঞ্জিনচালক নড়াইল লোহাগড়া এলাকার মো: সালাউদ্দিন মোল্লা (৪০) ও মুন্সীগঞ্জ শ্রীনগর থানার জাহাজের বাবুর্চি রানা (২০)। এ ছাড়া আহত সুকানি মো: জুয়েল ফরিদপুর সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের সেকান্দর খালাসির ছেলে।
জামিন শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন এপিপি অ্যাডভোকেট শাহজাহান খান, এপিপি অ্যাডভোকেট শরীফ মাহমুদ সায়েম, এপিপি অ্যাডভোকেট মাসুদ প্রধানীয়া, এপিপি অ্যাডভোকেট ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম, আইনজীবী শামিম হোসেন, অ্যাডভোকেট মিল্টন ও অ্যাডভোকেট তোফায়েল।
আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে বলেন, তিনি প্রায় আট মাস ধরে এই জাহাজে চাকরি করছেন। জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময়মতো পেতেন না। বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া একাই ভোগ করতেন। এ ছাড়া জাহাজের মাস্টার কর্মচারীদের সাথে রাগারাগি করতেন। কারো ওপর নাখোশ হলে তাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতেন। তাদের বকেয়া বেতনও দিতেন না। এসব নিয়ে তিনি মাস্টারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর আকাশ তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রেখে দেন। ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় তারা মোট ৯ জন জাহাজে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। ওই রাতে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে প্রথমে তিনি মাস্টারকে হত্যা করেন। পরে একে একে অন্যদের কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সব জাহাজ তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেলে আকাশ নিজে জাহাজ চালাতে থাকেন। জাহাজটি একপর্যায়ে ইশানবালা খালের মুখে মাঝিরচরে আটকা পড়ে। তিনি জাহাজটি নোঙর করে পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রলারে বাজার করার কথা বলে উঠে পালিয়ে যান।
গতকাল র্যাব-১১ কুমিল্লার উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এমভি আল-বাখেরা জাহাজ থেকে গত সোমবার বেলা ৩টার পরে পাঁচজনের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। আর তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক দু’জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গতকাল রাতে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যার সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য দেন। সে হিন্দু পরিচয় গোপন রাখার জন্য সবার কাছে নিজেকে ইরফান নামে পরিচয় দিত।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মো: মোহসীন উদ্দিন জানান, লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের প্রতি পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা ও নৌপুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানিয়েছেন, আহত জুয়েল বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হাইমচর থানার ওসি মো: মহিউদ্দিন সুমন জানান, মঙ্গলবার রাতে ৩৯৬/৩৯৭ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন জাহাজের মালিক মাহবুব মুর্শেদ। মামলা নম্বর (১৭/১৬৬)। চাঁদপুর সদরের হরিণাঘাট নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ছেলে মাজেদুল ইসলামের লাশ গ্রহণ করতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা আনিচুর রহমান। নিহত দু’জনের পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
মাজেদুল ইসলামের বাবা আনিসুর রহমান বলেন, আমার মনি মাদরাসায় নাইনে পড়ত। এলাকার একজনের কথায় জাহাজে চাকরিতে পাঠাতে রাজি হয়। এখন তো আমার মনিকে হারিয়ে ফেললাম।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা