২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কেরানীগঞ্জে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলছে অবৈধ সিসা কারখানা

নিশ্চুপ প্রশাসন
-


ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে তেঘরিয়া ইউনিয়নে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে সিসা গলানোর কারাখানা। এসব কারখানায় নষ্ট ও বাতিল ব্যাটারি এবং পুরনো লোহার বর্জ্য এনে গলানো হচ্ছে। বর্জ্য গলানোর সময় এর ক্ষতিকারক ধোঁয়ায় ক্ষতি হচ্ছে স্থানীয় মানুষের। দূষিত হচ্ছে চার পাশের পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে ফসল ও জমি। পাশাপাশি এখানে কর্মরত কর্মচারীরাও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। সিসা কারখানার চার পাশে জন্মানো ঘাস খেয়ে হুমকির মুখে পড়ছে পশুপাখিরা। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাসের পর মাস চলে আসছে এ কারখানা। কারখানাটির কাগজপত্র দূরে থাক নেই ন্যূনতম সাইন বোর্ড। গতকাল উপজেলার আব্দুল্লাহপুরের পরেরগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার ভেতরে ২৫-৩০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। কেউ পুরনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট বের করছেন; কেউবা ধুয়েমুছে ব্যাটারির বর্জ্য সাফ করছেন, কেউ ব্যাটারি থেকে অ্যাসিড বের করছেন।

এসব শ্রমিক পুরনো ব্যাটারি ভেঙে অ্যাসিড বের করা ও সিসার কাজ করে রাত-দিন পাশের পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে থাকেন। ফলে পানির রঙ কালচে আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া ব্যাটারির অ্যাসিডের প্রকট গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। তারা জানান, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় টিনের বেড়া দিয়ে সাইন বোর্ড বিহীন গড়ে ওঠা ওই কারখানাটিতে দীর্ঘদিন ধরেই পুরনো ব্যাটারি থেকে সিসা পোড়ানো হচ্ছে। এতে কারখানার আশপাশের তিন কিলোমিটারের মধ্যে ক্ষেতের ফসল ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি গাছপালা ও সবজির ক্ষতি হচ্ছে। অনেকের শ্বাসকষ্টসহ শারীরিক নানান জটিলতা দেখা দিয়েছে। অবিলম্বে সিসা কারখানাটি বন্ধসহ সিসা তৈরিতে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি তাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারখানার শ্রমিক বলেন, গরিব মানুষ কাজ করে খেতে হয়। অন্য কাজ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ব্যাটারি কারখানায় কাজ করছি। অন্য কোথাও কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এখানেই কাজ করতে হবে। কী কাজ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো ব্যাটারি কিনে এখানে এনে ভেঙে প্লাস্টিক আলাদা করে সিসা সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে পরদিন ভোর ৪টা পর্যন্ত ব্যাটারির প্লেট পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, খোলামেলাভাবে এসব অ্যাসিড গ্যাস বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে হুমকির মুখে পড়তে পারে জীববৈচিত্র্য। আর কৃষিবিদরা আশঙ্কা করছেন ফসলি জমির দীর্ঘমেয়াদি উর্বরতা হারানোর। সব মিলিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশ ও স্থানীয় মানবস্বাস্থ্যের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে হালতি বিলের বানিয়াপুকুর এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে সিসা গলানোর কারখানাটি।
চিকিৎসকরা বলছেন, ব্যাটারির বর্জ্য পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে তা আশপাশে থাকা মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসহ ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানায়, একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের জনৈক খোরশেদ জমিদারের ছত্রছায়ে চলছে এই অবৈধ সিসা কারখানা। সিসা কারখানা থেকে এই নেতা প্রতি মাসে প্রতিটি কারখানা থেকে লক্ষাধিক টাকা মাসোয়ারা নেন। খোরশেদ জমিদার উপজেলা প্রশাসন থানা পুলিশ ম্যানেজ করেন। কিছুদিন আগে এলাকাবাসী এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কাছে অভিযোগ করলে সেনাবাহিনী সদস্যরা এসে সিসা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে যায়। এতে কিছু দিন বন্ধ ছিল কারখানাগুলো এখন আবারো চালু হয়েছে। আমরা এই সিসা কারখানা থেকে মুক্তি চাই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টিপু নামের জনৈক ব্যক্তি বিগত সরকারের শাসনামলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানকে মাসোয়ারা দিয়ে কারখানাগুলো চালু করেছিল। শাহিন চেয়ারম্যান ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতার ছত্রছায়ায় কারখানাটি চালু রয়েছে। কারখানার সার্বিক ব্যবস্থাপনার দয়িত্বে থাকা সজিব বলেন, নাসির, জাহিদ, ইব্রাহিম, সাইফুল, টিপু তারা মিলে এখানে চারটি সিসা কারখানা পরিচালনা করছেন। প্রতিটি কারখানাতে ২৫-৩০ জন শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। এখানে স্থানীয় খোরশেদ জমিদার বিষয়টি দেখাশোনা করেন। তিনি সবকিছু ম্যানেজ করে। প্রশাসন আসলে তার সাথে কথা বলে। সিসা তৈরির কারখানার কোনো অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে সজিব বলেন, আমার কাছে পরিবেশ অধিদফতরের কোনো অনুমতি নেই । এ বিষয়ে খোরশেদ জমিদারের সাথে মুঠোফোন একাধিক যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল বন্ধ থাকায় যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
কেরানীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়া বলেন, এ কারখানাগুলোর কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ নষ্ট করে। ইতোমধ্যে কেরানীগঞ্জে অবৈধ সিসা কারখানা অনেক বন্ধ করেছি। কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement