২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গাছ না লাগালেও ঠিকাদারকে ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ

গাছ শূন্য কর্নফুলী টানেল এলাকা : নয়া দিগন্ত -

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে দুর্নীতি
- এটি চুক্তির আইটেম নম্বর ১০ এর লঙ্ঘন
- অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার সুপারিশ

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পে চুক্তি অনুযায়ী গাছ না লাগানো সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করে দেয়া হয়েছে। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ঊনপঞ্চাশ কোটি ছত্রিশ লাখ ছেচল্লিশ হাজার চারশত পঁয়ষট্টি টাকা। বাস্তবায়নে সম্পাদিত চুক্তির ১০ নম্বর শর্ত ছিল গাছ লাগানো। তাই গাছ না লাগিয়ে টাকা নেয়া চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সেতু বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের দায়িত্বশীলরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি আর্থিক নিরীক্ষায় সরকারের ক্ষতি হওয়া টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। এই অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার এ-অডিটর জেনারেলের কার্যালয় থেকে অডিট সম্পাদন করা হয়েছে। চিহ্নিহ্নত অনিয়মের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রস্তুত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু উদঘাটিত দুর্নীতির এই ফাইল সেতু ভবনে গত ১০ মাস ধরে চাপা পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। নিরীক্ষাকালে প্রকল্পের নির্মাণকাজের চুক্তির দলিল, নকশা, আইপিসি ও পেমেন্ট ডকুমেন্টস পর্যালোচনায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এতে দেখা গেছে, প্যাকেজ নম্বর ডব্লিউডি ১ এর আওতায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে মাল্টি লেন সড়ক টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ চায়না কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের সাথে ৭০ কোটি ৫৮ লাখ মার্কিন ডলারের ১টি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

প্রকল্প এরিয়ায় টানেলের পশ্চিম পাশে ৫৫০ মিটার রাস্তার এবং পূর্ব পাশে ৪০০ মিটার রাস্তার দুই পাশের ঢালু এবং টোল প্লাজা এরিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণের জন্য আইটেম নম্বর ১০১০-০০৩ হতে ১০১০-০০৬ এর অধীন ৭৩,৭৭,৪৯,৮১৯ টাকা (৬৭,৬৮,৩৪৬.৯৬ মার্কিন ডলার) চুক্তি মূল্য নির্ধারিত ছিল। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালের ৩০ জুন আইপিসি নম্বর ৩৭ এর মাধ্যমে টানেলের পশ্চিম এবং পূর্ব পাশে রাস্তার দুই পাশে এবং টোল প্লাজা এরিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ দেখিয়ে মাইলস্টোন (লামসাম) ভিত্তিতে ৪৯,৩৬,৪৬,৪৬৫ টাকা (৪৫,২৮,৮৬৭.০০০ মার্কিন ডলার) ঠিকাদারকে চূড়ান্তভাবে পরিশোধ করে দেয়।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: আবুল কালাম আজাদ, উপ-প্রকল্প পরিচালকের উপস্থিতিতে পশ্চিম পাশে পতেঙ্গা প্রান্তে অ্যাট গ্রেড রোড (ধঃ মৎধফব ৎড়ধফ) হতে পূর্ব পাশে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত ৫.৪ কিলোমিটার রাস্তা এবং টোল প্লাজা এরিয়ায় সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সরেজমিন তারা দেখতে পান, বর্ণিত স্থানে কোনোরূপ বৃক্ষরোপণ করা হয়নি। তবে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৫ জিওবি খাত হতে নির্মিত এক্সেস রোডের মাঝখানে (মিডিয়ানে) বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। ওই বৃক্ষরোপণের কাজটি আলাদা চুক্তির মাধ্যমে প্রকল্পের জিওবি খাত থেকে সম্পাদন করা হয়েছে।
প্রতিটি গাছ লাগানোর জন্য ২ হাজার টাকা হিসাব করা হলে পরিশোধিত ৪৯,৩৬,৪৬,৪৬৫ টাকায় ২,৪৬,৮২৩টি গাছ রোপণ করা সম্ভব হতো। চুক্তিতে বর্ণিত বৃক্ষরোপণ না করা সত্ত্বেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশক্রমে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করে দিয়েছেন। ফলে আইটেমের বিপরীতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ ও বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও গাছ রোপণের কাজ না করায় সরকারের ৪৯,৩৬,৪৬,৪৬৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে বড় রকমের অনিয়ম হয়েছে এবং চুক্তির আইটেম নম্বর ১০ এর লঙ্ঘন হয়েছে।

নিরীক্ষায় দেখা গেছে, গুল্ম ও বৃক্ষরোপণের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নকশা ছিল না। চুক্তির পরে নিয়োগকর্তা (প্রকল্প কর্তৃপক্ষ) কর্তৃক অনুমোদিত নকশার সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য এবং ডাটা যাচাই করা হয়। চুক্তির শর্ত মেনেই এসব ডিজাইন করা হয়। প্রকল্পের প্রয়োজন এবং অনুমোদন অনুসারে নকশা সংশোধন করা হয়। ঠিকাদার পুরো কাজটি পুনরায় ডিজাইন করে। চুক্তির অধীনে কোনো কাজ বাস্তবায়নের আগে নিয়োগকর্তার (প্রকল্প কর্তৃপক্ষ) কাছ থেকে অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এটি একটি লামসাম চুক্তি, হারের শিডিউল রেট অনুযায়ী চুক্তি নয়। চুক্তিতে উল্লিখিত তফসিল ৪ [পেমেন্টের শিডিউল] অনুসারে মাইলস্টোন ভিত্তিতে ঠিকাদারকে অর্থ প্রদান করেছে। নিয়োগকর্তা কর্তৃক অনুমোদিত স্থাপত্য নকশা এবং পদ্ধতির ভিত্তিতে কাজগুলো বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এ ব্যাপারে অডিট কর্তৃপক্ষের মতামত জানতে চাইলে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী বৃক্ষরোপণ না করলে ঠিকাদার বিল প্রাপ্য নয়। কিন্তু বুশ এবং সংশ্লিষ্ট বৃক্ষরোপণের জন্য ৪৯,৩৬,৪৬,৪৬৫ টাকা পরিশোধ করা হলেও চুক্তি অনুযায়ী এ ধরনের বুশ বা বৃক্ষরোপণ বাস্তবায়ন করা হয়নি। তারা বলেন, কাজ বাস্তবায়ন না করা সত্ত্বেও বিল প্রদান করায় সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নিকট হতে আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে আমরা সুপারিশ করেছি।

 


আরো সংবাদ



premium cement