আরাকান এখন বাংলাদেশী ও ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৪
মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সাথে যুদ্ধ করে রাখাইন বা আরাকান রাজ্য মুক্ত করেছে আরাকান আর্মি। কিন্তু ওই অঞ্চলের পণ্যচাহিদা বাংলাদেশ ও ভারত থেকে জোগানের ওপর নির্ভর করছে। সমগ্র অঞ্চলটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যার অর্থ হলো মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে সামরিক অবরোধ অনির্দিষ্টকালের জন্য অব্যাহত থাকবে। ভারত ও বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণ সম্ভব হলে এ অঞ্চলের মানুষের কষ্ট কমানো যেত কিন্তু এই দু’টি দেশ এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ড বা চীনের মতো মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে জড়িত হতে আগ্রহী হয়নি। আরাকান রাজ্য সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্লেষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন মিডিয়া দি ডিপ্লোম্যাট। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে চোরাচালান করা পণ্য মিয়ানমারের আরাকানের জন্য এখন লাইফলাইন। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি এবং ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের কারণে আরাকানে আসন্ন সঙ্কট ঠেকাতে এগুলো যথেষ্ট নাও হতে পারে। প্রতিদিন বিকেলে, মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে কালাদান নদীর তীরে বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং লিঙ্গের প্রায় দুই ডজন মানুষ জড়ো হয়। তারা ভারত সীমান্ত থেকে আসা সব নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকে; তাদের বেশির ভাগই প্রতিবেশী রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন জনপদে ভাটির দিকে যাত্রা করে।
উপস্থিত মানুষের বেশির ভাগই দোকানদার এবং ব্যবসায়ী, যারা ভারতের মিজোরাম থেকে পাচার করা পণ্যের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। পণ্যগুলো সংগ্রহ করে কিছু যানবাহন এবং মোটরবাইকে করে শহরের কাছাকাছি অন্যান্য গন্তব্যে নিয়ে যায়। দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতোয়ার মতো, রাখাইন রাজ্যের লোকেরা প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশ থেকে চোরাচালান করা পণ্যের ওপর নির্ভর করে। কারণ মূল ভূখণ্ড মিয়ানমার থেকে সরবরাহের পথ বন্ধ রয়েছে। রাখাইন এবং দক্ষিণ চীন রাজ্যের আরাকান সেনাবাহিনীর দখলে থাকা অঞ্চলে মোটরযান চলাচলযোগ্য রাস্তার অভাবের কারণে, পণ্যগুলো বেশির ভাগই নৌকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কেন আরাকান চোরাচালান পণ্য প্রয়োজন?
প্রতিরোধ গোষ্ঠী এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা অঞ্চলগুলোর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের গৃহীত কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের মৌলিক খাদ্যসামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় পণ্য থেকে বঞ্চিত করার জন্য সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়া। এই কৌশলটি, যা আরাকানেও গৃহীত হয়েছিল, গত বছরের ১৩ নভেম্বর আরাকান আর্মি আক্রমণ শুরু করার পরে এ কৌশল আরো তীব্র হয়। মিয়ানমার জান্তা মূল ভূখণ্ড এবং রাখাইন রাজ্যের দক্ষিণ অংশ থেকে সরবরাহ রুট বন্ধ করে দিয়েছে।
পালেতোয়ার ইউএলএ-এর রাজনৈতিক কমিশনার কিয়াও জাও ওও, ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন যে আরাকানও ‘পর্যাপ্ত পরিমাণে’ সবজি চাষ করে, যা অন্যান্য অঞ্চল থেকে এই পণ্যগুলোর আমদানিকে অপ্রয়োজনীয় করে। রাখাইন রাজ্য চালের জন্য অন্য কোনো অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল নয়। তবে শাকসবজি, মাছ, লবণ এবং চিনি বাদ দিয়ে, প্রায় সব কিছুরই প্রয়োজন আছে আমদানির। রান্নার তেল, বিস্কুট, সাবান, ডিটারজেন্ট, বাসনপত্র, ময়দা, গার্মেন্টস এবং ব্যাটারিসহ বিভিন্ন আইটেম ভারত ও বাংলাদেশ থেকে আরাকানে নদী ও স্থলপথ দিয়ে পাচার করা হয় যা এই অঞ্চল অতিক্রম করে। এই আইটেমগুলো সাতটি টাউনশিপের দোকানে বিক্রি করা হয়। এ শহরগুলো হচ্ছে, পালেতওয়া, কিয়কতাও, পোন্নাগিউন, মিনবিয়া, রাথেডাং, বুথিডাং এবং ম্রাউক ইউ।
ধর্মন জলরাজ, ভারত থেকে আসা হিন্দিভাষী অভিবাসীদের ছেলে, কিউকটাও শহরের উপকণ্ঠে বসবাসকারী একজন শ্রমিক। নদীর তীর থেকে শহরের বিভিন্ন দোকানে পণ্য পরিবহনের জন্য রাখাইন বৌদ্ধ ব্যবসায়ীর সাথে নিয়মিত নিয়োজিত থাকেন। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার অনেক বাসিন্দা ভারত থেকে আসা পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হলে আমরা অনাহারে মরব।
জলরাজের মতে, শীতের মৌসুমে যখন ভারত সীমান্ত থেকে কালাদান নদীতে ছোট-বড় ৪০টিরও বেশি নৌকা কিউকতাউতে পৌঁছায় তখন পণ্যের প্রবাহ বেড়ে যায়। বর্ষাকালে এটি প্রায় ১৫টি নৌকায় নেমে আসে। এই অঞ্চলটি জ্বালানি (ডিজেল এবং পেট্রল) এবং ওষুধের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। এই দু’টি জিনিস যাতে গোপন পাহাড়ি পথ দিয়ে মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে আরাকানে পাঠানো না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য জান্তা অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে।
ওষুধের সরবরাহ অনিয়মিত
রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালের ডাক্তার তার নাম বা হাসপাতালের অবস্থান প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ঝুঁকিতে আছে। গত তিন মাসে অন্তত ছয়টি বোমাবর্ষণের কথা জানান তিনি। ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা একটি ‘অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ’ ছিল, কারণ স্বাস্থ্যকর্মী এবং ওষুধের ‘চরম অভাব’ রয়েছে। বর্তমানে আরাকানের মুক্ত এলাকায় মাত্র ২০ জন চিকিৎসক রয়েছেন বলে তিনি জানান। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আসে। ওষুধের সরবরাহ অনিয়মিত। তবে ভারত থেকে ওষুধ আসে বেশি। ওষুধের চালানগুলোকে সীমান্ত থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়, গন্তব্যে তা নিয়ে যাওয়ার জন্য যানবাহন এবং নৌকার প্রয়োজন হয়। আমাদের কাছে এখন যে ওষুধ রয়েছে তার বেশির ভাগই যুদ্ধের আগে মজুদ ছিল। প্রতিটি ওষুধেরই বড় অভাব। উদাহরণস্বরূপ, একটি সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারে, সাধারণত তিন ধরনের থ্রেড ব্যবহার করা হয় কিন্তু এখন আমরা শুধুমাত্র একটি দিয়ে তৈরি করছি, জানান এই ডাক্তার।
এই ডাক্তার বলেন, ওষুধের দাম অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে গেছে। নি¤œ-আয়ের গোষ্ঠীর লোকেরা কিছু ওষুধ কেনার সামর্থ্য রাখে না এবং এমন রোগী আছে যে তিন দিন ধরে ওষুধের অপেক্ষায় আছেন। প্রধানত জলবাহিত রোগ, যেমন ডায়রিয়া এবং আমাশয় আক্রান্ত হয় বেশি। আমরা নিয়মিত ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং জ্বরের কেস পাচ্ছি। কখনো কখনো পাকস্থলীর ক্যান্সারও হয়। স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। যে কোনো সময় এসব কেন্দ্রে বোমা হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা থাকায় বাসিন্দারা চিকিৎসা নিতে আসতে ভয় পাচ্ছেন।
বুথিডাং শহরের আইডিপি ক্যাম্পের একজন বন্দী ২৫ বছরের থান টিন হ্লাইং। একটি সামরিক স্থাপনা থেকে পালানোর সময় একটি ল্যান্ডমাইনে তার ডান পা উড়ে যায়। স্পিন্টার তার ডান কাঁধ এবং বাম পায়ে বিদ্ধ হলেও ক্ষত পুরোপুরি সারেনি। ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারেন না থান। অথচ ওষুধ পাচ্ছেন না। সামরিক বাহিনী তার বাবা-মাকেও ক্যাম্পে স্থানান্তর করতে বাধ্য করে তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।
দু’জন বৃদ্ধ এবং দু’জন সদ্যোজাত শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। সব ক্যাম্পেই খাবার ও ওষুধের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশের অন্যান্য অংশের মতো, সামরিক শাসন স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরাকানের শিবিরগুলোতে মানবিক সহায়তা প্রদানে বাধা দিয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা