২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর দাবি

বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
-

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর দাবি করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভিনেগার, সয়াসস, হোয়ায়েটেনিং পাউডার, ব্লিচ, কচলেট পাউডার, বেবিফুডসহ ১৭-২০ ধরনের আমদানিকৃত পণ্য নকল ও ভেজাল হচ্ছে বেশি। এর কারণে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতির পাশাপাশি সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের ইমেজের ক্ষতি, আমদানিকারকদের ব্যবসায়িক লোকসান ও ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর বদনামসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয় না সেগুলোর আমদানি শুল্ক কমিয়ে চাহিদা অনুসারে পণ্য আমদানির সুযোগ দিতে হবে। একই সাথে টাস্কফোর্স গঠন করে বাজারে যেসব প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য নকল করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। সর্বোপরি বাজারে শৃঙ্খলা আনতে দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামে (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বাজারে ভেজাল পণ্যের প্রভাব এবং জনস্বাস্থ্যে এর ক্ষতিকর দিক’ বিষয়ে এক সেমিনারে এসব বিষয় উঠে আসে। ইআরএফ এবং বাংলাদেশ ফুডস্টাফ ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স এসোসিয়েশন (বাফিসা) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের (ডিএনসিআরএপি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। ইউএসডিএ ফান্ডেড বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রজেক্টের সহায়তায় এই সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের (ডিএনসিআরএপি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, দেশের বাজার থেকে নকল ও ভেজাল পণ্য উৎখাতের জন্য নৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এই নৈতিকতার ঘাটতির কারণে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা উন্নত দেশ গড়তে পারিনি। অথচ আমাদের পরে স্বাধীন হয়ে অনেক দেশ এগিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, দেশে দারিদ্র্যের হার বেশি হওয়ায় নকল পণ্যও বেশি হচ্ছে। কারণ গরিব মানুষ সস্তায় পণ্য খোঁজেন। আর সস্তায় পণ্য খুঁজলে নকল তো হবেই। এ ছাড়া শিক্ষার হার বাড়ানো ও মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনেরও প্রয়োজন রয়েছে। তাতে মানুষকে সচেতন করা সহজ হবে।
সেমিনারে বাংলাদেশের বাজারে নকল পণ্য তৈরি ও উৎপন্নের কারণ ও প্রতিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরে বক্তারা বলেন, যখন বাজারে আসল পণ্যের চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ কম থাকে অথবা যেটুকু সরবরাহ আছে তার মূল্য খুব বেশি বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে তখন কিছু অসাধু ব্যক্তি অতি মুনাফার আশায় নকল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে। বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যান্ডের মোড়ক ও প্যাকেট তৈরি করে অসাধু ব্যক্তিরা এই নকল পণ্য তৈরি করে। এই নকল পণ্য এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের তৈরি পণ্য খেয়ে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।
তারা বলেন, বিভিন্ন ধরনের সস, বেবিফুড, ভিনেগার, চকোলেট সিরাপ, অলিভ ওয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেগুলো দেশে উৎপাদন হয় না এমন ২০০ কনটেইনার পণ্যের চাহিদা রয়েছে বছরে। কিন্তু নকল পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন করার কারণে, এর দশ ভাগের এক ভাগ পণ্যও এখন আমদানি হয় না। এর কারণে সরকার বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ ফুডস্টাফ ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স এসোসিয়েশনের (বাফিসা) সভাপতি মোহাম্মদ বোরহান ই সুলতান বলেন, স্থানীয়ভাবে শিল্প গড়ে উঠুক এবং পণ্য তৈরি হোক এটা আমরাও চাই। কিন্তু সেটা মনসম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। আমাদের অনেক ব্যবসায়ী মাসে ২৫-৩০ কনটেনার পণ্য আমদানি করত। অধিক শুল্ক হারের কারণে এখন তারা মাত্র দুই-তিন কনটেনার আমদানি করেন। এসব পণ্য দেশে উৎপাদনও হচ্ছে না। আবার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। তা হলে এতো পণ্য আসতেছে কোথা থেকে। আপনারা বাজারে, হোটেল রেস্তোরাঁর কিচেনে খোঁজ নিলেই বুঝতে পারবেন আমরা কী পরিমাণ নকল পণ্য প্রতিদিন খাচ্ছি।

নকল পণ্যের কারণে বাংলাদেশের মানুষ মারাত্মক বড় রকমের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। যেমন, মানুষের এখন কিডনি, হার্ট এবং ক্যান্সারজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যার কারণে বিদেশের স্বাস্থ্য চিকিৎসার জন্য প্রচুর ডলার ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ১.৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। নকল পণ্যের কারণে বৈধ ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করে তা মেয়াদোত্তীর্ণের আগে বিক্রি করতে পারছেন না, এতে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। অনেকে দীর্ঘ দিনের ব্যবসা থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।
নকল পণ্যের দৌরাত্ম্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় বলতে গিয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, সকল পণ্যের ওপর ট্যাং বসানোর আগে দেখতে হবে, লোকাল পণ্যের বাজার মূল্য ও উৎপাদন খরচ কেমন রয়েছে। সে হিসাবেই ট্যাং ধরা উচিত। দেশে উৎপাদন হয় না অথচ বাজারে চাহিদা রয়েছে এমন পণ্য পর্যাপ্ত আমদানি না হলে বাজারে নকল পণ্যের উৎপাদন ও ছড়াছড়ি বাড়বে। তাই আমদানি স্বাভাবিক রাখতে হবে। নকল পণ্যে বাজারজাতকরণে নিরুৎসাহিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এ জন্য টাস্কফোর্স গঠন করে, দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এ খাতে কাজ করা ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রচার ও প্রসারের সুপারিশও করেন অনেকে।

বাংলাদেশ ফুডস্টাফ ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স এসোসিয়েশনের (বাফিসা) সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন যে পণ্য আমাদের আমদানি খরচ প্রতিকেজি এক হাজার টাকা। বাজারে তা ৩০০-৪০০ টাকা কেজি পাওয়া যায়। আসল পণ্যের তুলনায় নকল পণ্য ৫০ শতাংশ কম দামে বাজারে পাওয়া যায়। কী করে এতো কম দামে বিক্রি হয়। বড় ব্র্যান্ড কোম্পানির অনেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে নকল পণ্যের ছড়াছড়ি দেখে বিমুখ হয়ে ফিরে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির সদস্য ড. মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, গত বছর আমরা বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের ১৩৮১টি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্ট করিয়েছিলাম। তাতে ২০ শতাংশ পণ্যই মানহীন পাওয়া গেছে। আমরা শাস্তি দেয়ার চেয়ে মানুষকে সচেতন করার দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। এতে ভেজাল খাদ্য উৎপাদন কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন বলেন, দেশে ভেজাল খাদ্য বা পণ্য প্রতিরোধে একটা টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সবপক্ষের প্রতিনিধি থাকবেন।


আরো সংবাদ



premium cement