২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রকল্পের পুরো কাজ দেখতে ৯ জোনে তদারকি কমিটি

সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের নামে লুটপাট বন্ধে উদ্যোগ
-

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়নের নামে সড়ক ও মহাসড়কের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে (চলমান ও শেষ) ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন প্রতিটি প্রকল্পের কাজে নানাভাবে দুর্নীতি হয়েছে। আর এসব অনিয়মের সাথে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পিডি থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তাই কম-বেশি জড়িত ছিলেন। তারা তাদের মনোনীত ঠিকাদারদের দিয়ে নিম্নমানের কাজ করিয়ে নানা কৌশলে প্রকল্প থেকে কমিশন বাণিজ্য করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

বিগত দিনে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের নামে এমন লুটপাটের চিত্রকে সামনে রেখে এবার কেউ যাতে আর সরকারি টাকা নয়ছয় করতে না পারে সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রকল্প কাজের মান ঠিক রাখতে প্রতি জোনে তদারকি কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন।

তারই ধারাবাহিকতায় সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে প্রতি জোনে তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা, রংপুর, খুলনাসহ পৃথক ৯ জোনের জন্য ৭টি তদারকি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যদের প্রকল্প কাজের গুণগতমান ঠিক ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি-না তা সরেজমিন দেখে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে গত সপ্তাহে এক অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।

গত ১৮ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের (প্রশাসন শাখা) উপ-সচিব রাসেল মনজুর স্বাক্ষরিত ওই অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন প্রতিটি প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রয়, দরপত্র, মোবিলাইজেশন ইত্যাদিসহ মাঠ পর্যায়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজ সরেজমিনে তদারকি করার জন্য পৃথক তদারকি কমিটি গঠন করা হলো।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহবায়ক (অনুবিভাগ) এবং যুগ্ম সচিবকে (সওজ জিওবি) সদস্য করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হচ্ছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সওজ সংশ্লিষ্ট জোন), উপ-পরিচালক-৪ পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-২, আইএমইডি, জেলা প্রশাসক এর প্রতিনিধি, সওজের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব (ডিএফডিপি)। এভাবে অন্যান্য জোনে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অফিস আদেশে দেখা গেছে, সারা দেশে সড়কের ৯টি জোনের মধ্যে রংপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা ছাড়া বাকি দুই জোনের জন্য একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জোনের জন্য একটি কমিটি, রাজশাহী ও ময়মনসিংহের জন্য একটি এবং খুলনা ও বরিশাল জোনের জন্য একটি কমিটি করা হয়। প্রতিটি কমিটিতে মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা প্রশাসকের একজন করে প্রতিনিধি রয়েছেন।

কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, পিরিয়ডিক মেইনটেনেন্স প্রোগ্রাম (পিএমপি) মেজর ও মাইনর কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত কাজ স্পেসিফিকেশন ও গুণগত মান রজায় রেখে ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে কি-না তা তদারকি করা এবং পিএমপি (মাইনর) ও অন্যান্য রাজস্ব বাজেটের ব্যয় পরিকল্পনা ও গৃহীত কার্যক্রম তদারকি করা।

এডিপিভুক্ত চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ তদারকি করা, সড়ক নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং যানচলাচল ও জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে এমন যে কোনো বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা ছাড়া, পূর্ববর্তী পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রদত্ত পরামর্শ, নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না তদারকি কমিটিতে তা খতিয়ে দেখা, ফেরিঘাট ও ফেরি পন্টুনের ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে কি-না, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তিগুলো বিষয়ে গৃহীত কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা, কমিটিগুলো প্রতি মাসে অন্তত ২ বার বিশেষ করে সরকারি ছুটির দিনে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে জমা দিয়ে এর অনুলিপি সংশ্লিষ্ট জোনের দায়িত্বপাপ্ত সমন্বয়কারী এবং এই বিভাগের মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন শাখায় দাখিল করতে হবে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টসহ মোট ৪১টি মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রকল্প চলমান রয়েছে। আবার কোনোটির কার্যক্রম শেষ হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রকল্প পরিচালকদের নির্লিপ্ততায় ঠিকাদাররা ঠিকমতো কাজ না করেই বিল পাস করিয়ে নিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কোনো ঠিকাদারই সংশ্লিষ্টদের পার্সেন্টেজ না দিয়ে চেক পাননি। প্রকল্পগুলোর কাজের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ার পাশাপাশি নিম্নমানের পণ্য সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ করছেন তারা। বর্তমান সরকারের কাছে তাদের দাবি, গত সরকারের আমলে যেসব মেগা প্রকল্পের নামে মেগা লুটপাট হয়েছে সেগুলোতে কী ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করা এবং জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা।

এ প্রসঙ্গে সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এমন অভিজ্ঞরা নয়া দিগন্তের কাছে বলেছেন, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রকল্পের কাজে দুর্নীতি বন্ধের লক্ষ্যে যাদেরকে দিয়ে তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের মধ্যে কেউ বিগত সরকার আমলের সুবিধাভোগী ছিলেন কি না তা দেখতে হবে। যদি থেকে থাকেন, তাহলে তাদেরকে চিহ্নিত করে কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। নতুবা যে উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে সেটি ভেস্তে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

 


আরো সংবাদ



premium cement