কলেজছাত্র তালিব এখন নির্মাণশ্রমিক
- বাসস
- ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩২
প্রায় দুই মাস মৃত্যুর সাথে লড়াই শেষে হার মানেন মো: বাবলু মৃধা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ নির্মাণশ্রমিক বাবলু মৃধা গত ১৯ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। আর সংসারের দায় মেটাতে কলেজের পড়ালেখা ছেড়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন পুত্র তালিব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনরত ১৭ বছর বয়সী ছেলে মো: আবু তালিবকে খুঁজতে যান বাবলু মৃধা। ঘটনাটি ১৯ জুলাইয়ে যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকার। ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
বাবলুর শোকাহত ছেলে তালিব সম্প্রতি বলেন, ‘সেদিন হাজার হাজার লোকের সাথে আমিও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম বলে আমার বাবা আমাকে খুঁজতে শনির আখড়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া একটি গুলি তার বুকে লেগে পেটের ভেতর আটকে যায়।’
দনিয়া ইউনিভার্সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তালিব তার দিনমজুর বাবার সাথে যাত্রাবাড়ীর দনিয়ার গুয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় থাকতেন। তার মা সীমা বেগম ও আড়াই বছরের ভাই মো: মহিম হাসান পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
তালিব জানান, সেদিন রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে তার বাবাসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয় লোক তাদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার বাবাকে প্রথমে ধোলাইপাড় এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রেফার করেন। তালিব জানান, সন্ধ্যায় তার বাবা গুলিবিদ্ধ হলেও তারা রাত ২টার দিকে খবর পান। তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, আমার বাবাকে যখন ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী একজন পুলিশ অফিসার তাকে চিনতে পেরে আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে ফোন করেন। পরে চেয়ারম্যান গ্রামে আমার চাচাকে খবর দেন। অবশেষে আমি রাত ২টার দিকে চাচার কাছে খবর পেয়ে সাথে সাথে হাসপাতালে যাই।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তালেব জানতে পারেন তার বাবাকে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। তালিব জানান, তার বাবা মারা গেছেন ভেবে ঢামেক হাসপাতালের কিছু লোক তাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই পুলিশ অফিসার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
বাবলু ঢামেক হাসপাতালে ১ মাস ২০ দিন চিকিৎসা নেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি সিএমএইচ হাসপাতালে মারা যান। ময়নাতদন্তের পর বাবলু মৃধার লাশ দশমিনা উপজেলায় তাদের পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তালিব জানান, ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত তার পরিবারই চিকিৎসার খরচ বহন করে। তবে ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ের সব চিকিৎসার খরচ বহন করেছে সরকার। তিনি বলেন, ৩ আগস্ট পর্যন্ত বাবার চিকিৎসার জন্য আমরা এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করেছি। আন্দোলনে যোগ দেয়ার বিষয়ে তালিব জানান, তার বাবা বিএনপির সমর্থক ছিলেন। তিনি বিএনপির কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন।
তালিব জানান, আমি আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু ১৭ জুলাই থেকে এই আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয় তখন আমার বাবাও আন্দোলনে যোগ দেন। তার বাবাও সেদিন শনিরআখড়া এলাকায় বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু একটি বুলেট তাকে তার বাবার কাছ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তালিব বলেন, বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবার একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ বাবাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বলেন, আমার বাবা ২০ বছর ধরে গুয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। আমি সেখানেই বাবার সাথে থাকতাম। তিনি আমার লেখাপড়ার খরচ বহন করতেন এবং গ্রামে আমার মা এবং ছোট ভাইয়ের জন্য টাকা পাঠাতেন।
কিন্তু তালিব এখন নিজের পড়াশোনা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ মা ও ছোট ভাইয়ের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি ইতোমধ্যেই নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছেন। তালিব অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘জানি না আমি আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারব কিনা। কারণ নির্মাণশ্রমিকের কাজের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।’
তালেব তার গ্রামের উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৩.৪৪ পেয়ে এসএসসি পাস করে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হন। এর আগে তিনি তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত দনিয়া এলাকার স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে গ্রামে গিয়ে সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন। বর্তমানে ধোলাইপাড় এলাকায় একটি ব্যাচেলর মেসের বাসিন্দা তালিব বলেন, ‘আমাদের কোনো জমি বা বাড়ি নেই। আমরা দিন এনে দিন খাওয়া পরিবার। এখন প্রতি মাসে আমি প্রায় ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করতে পারি। এই টাকা থেকেই আমি আমার খরচ বহন করে মায়ের কাছে টাকা পাঠাই।’ তিনি বলেন, বাবার মৃত্যুর পর থেকে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি নগদ কোনো সহায়তা পাইনি।
বাবলুর শোকাহত পুত্র তালেব বলেন, বর্তমানে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করে সংসার চালিয়ে পড়ালেখা করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যদি সরকার আমাদের পরিবার চালাতে সহায়তা করে অথবা আমাকে একটা উপযুক্ত চাকরি দেয় তাহলে পরিবারের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে পারতাম। তালিবের মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে তালিব জানান, তার মা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা