১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সারে টান, আবাদে শঙ্কা

বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ইউরিয়া-নন ইউরিয়া বিভিন্ন জেলায় জেল-জরিমানা
-

এক কেজি ইউরিয়া সার কৃষকপর্যায়ে বিক্রি করার কথা ২৭ টাকায়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পাঁচলিয়া বাজার ও বোয়ালিয়া বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকায়। একইভাবে কৃষকপর্যায়ে এমওপি প্রতি কেজি ২০ টাকার পরিবর্তে ২৪ টাকায়, ডিএপি ২১ টাকার পরিবর্তে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বস্তাপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দাম রাখছেন বিক্রেতারা। গতকাল উপজেলার দু’টি বাজারে খুচরাপর্যায়ে এভাবে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করতে দেখা যায়। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, পঞ্চগড়, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, রাজশাহী, রাজবাড়ী, বগুড়া, গাইবান্ধা, নওগাঁ, খুলনাসহ দেশের প্রায় সব জায়গায়ই ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার বেশি দামে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বোরো মৌসুমে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়ায় কিছুটা টান পড়ায় এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি থেকে যে পরিমাণ সারের প্রয়োজন, তা মজুদ নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ সারের মজুদ গড়ে তুলতে না পারলে দেশে কৃষিপণ্যের সর্বোচ্চ উৎপাদন মৌসুমে সারের সরবরাহে চরম অস্থিরতা তৈরি হওয়ারও শঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এমন একটা সময়ে কৃষকদের সারের পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে যখন চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম শুরু হয়েছে। এই বোরো মৌসুমে দুই কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়, যা সারা বছরের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখে। একই সাথে এই মৌসুমে সারা বছরের জন্য পেঁয়াজ, আলু, সরিষা,গম উৎপাদন হয়। প্রচুর পরিমাণে সবজি উৎপাদনের এই সময়টাতে বাজারে বিভিন্ন সবজির দাম থাকে নাগালের মধ্যে। এ জন্য ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কে পিক সিজন ধরা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) নন ইউরিয়া-টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের জোগান দিয়ে থাকে। বিএডিসির পাশাপাশি নন-ইউরিয়া সারের একটা জোগান আসে বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নন-ইউরিয়া ও ইউরিয়া সারের মজুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নন-ইউরিয়া হিসেবে পরিচিতি টিএসপি সারের ডিসেম্বর-মার্চ পর্যন্ত চার মাসের চাহিদা তিন লাখ ৬১ হাজার মে. টন, ডিএপি সারের চাহিদা সাত লাখ ৪৪ হাজার টন এবং এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে চার লাখ ১৩ লাখ মে. টন। এর বিপরীতে বিএডিসির গুদাম ও পরিবহনাধীন সারের মোট মজুদের মধ্যে টিএসপি এক লাখ দুই হাজার মে টন, ডিএপি এক লাখ ৩৯ হাজার মে. টন এবং এমওপি সার রয়েছে দুই লাখ ২৯ হাজার মে. টন। এটি প্রতিষ্ঠানটির গত ১০ ডিসেম্বরের হিসাব। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এই মুহূর্তে বিএডিসির বাইরে বেসরকারি খাতের নন-ইউরিয়া সারের কোনো মজুদ নেই। পাইপ লাইনে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আসার কথা।
কৃষি মন্ত্রণালয় ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে যে পরিমাণ সার বরাদ্দ দিয়েছে সেখানে বিএডিসি টিএসপি বিতরণ করবে ৯৩ হাজার ৬৪৬ মে. টন, ডিএপি এক লাখ ৮৩ হাজার মে. টন এবং এমওপি বিতরণ করবে এক লাখ ২৯ হাজার মে. টন। অর্থাৎ বিএডিসির হাতে জানুয়ারিতে সরবরাহ করার মতো পর্যাপ্ত সারের মজুদ নেই।
এর বাইরে ডিসেম্বর মাসের চাহিদার একটা অংশ সরবরাহ করবে বেসরকারি আমদানিকারকরা। বিএডিসির বাইরে মোট চাহিদার ২৫.৬৮ শতাংশ টিএসপি, ৩০.৪৩ শতাংশ ডিএপি এবং ১৮.৩৭ শতাংশ এমওপি সার সরবরাহ করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ সারের চাহিদার অধিকাংশই সরবরাহ করে থাকে বিএডিসি, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে মজুদ গড়ে তুলতে পারেনি। আবার বেসরকারি আমদানিকারকদের কাছেও মজুদ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএডিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আমদানির পাইপলাইনেও পর্যাপ্ত পরিমাণ সার নেই, যা দিয়ে পিক সিজনের চাহিদার পুরোটা সামাল দেয়া সম্ভব।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) স্থানীয় উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে ইউরিয়ার জোগান দিয়ে থাকে। তবে ইউরিয়া সারের টানাটানি শুরু হয়েছে এ বছরের শুরু থেকেই। সারা বছরে ইউরিয়ার চাহিদা ৩২ লাখ মে. টন। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য ইউরিয়ার চাহিদা ২৭ লাখ মে. টন। এর বাইরে নিরাপত্তা মজুদ হিসেবে থাকার কথা পাঁচ লাখ টন। মোট চাহিদার মধ্যে শুধু এই চার মাসেই (ডিসেম্বর-মার্চ) ইউরিয়ার চাহিদা সাড়ে ১৪ লাখ টন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে যে মজুদ তৈরি হয়েছে তা নিরাপত্তা মজুদ বাদে শুধু ডিসেম্বরের চাহিদাই পূরণ করবে। ডিসেম্বর মাসের সারের চাহিদা তিন লাখ ১৫ হাজার মে. টনের বেশি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে নিরাপত্তা মজুদসহ বিসিআইসির হাতে আছে সাত লাখ ২৫ হাজার মে. টন। যে মজুদ দেখানো হয়েছে ডিসেম্বরে দেড় লাখ মে. টনের সম্ভাব্য আমদানি ধরে, সেটি এখনো দেশে পৌঁছেনি। অর্থাৎ ডিসেম্বরের সার ব্যবহার করলেই হাত পড়বে নিরাপত্তা মজুদে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য আমদানি ধরেও আগামী মার্চে গিয়ে প্রায় দেড় লাখ টন ইউরিয়া ব্যবহার করতে হবে নিরাপত্তা মজুদ থেকে। যেটা উৎপাদন বৃদ্ধি করে বা বর্তমান আমদানি চুক্তির বাইরে গিয়ে সংগ্রহ করতে হবে।
এ দিকে চলতি ডিসেম্বরে দেড় লাখ মে. টন, আগামী জানুয়ারিতে দুই লাখ ১০ হাজার, ফেব্রুয়ারিতে প্রায় দেড় লাখ এবং মার্চে ৩০ হাজার মে. টনের সম্ভাব্য আমদানি ধরেই ইউরিয়ার মজুদ হিসাব করা হয়েছে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কারণে যদি আমদানি হওয়া সার ঠিক সময়ে দেশে না আসে তাহলে সঙ্কট বড় হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইউরিয়া সার নিয়ে টানাটানি এই অর্থবছরের শুরু থেকেই। দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট, ডলারের সঙ্কটসহ বিভিন্ন কারণেই ঠিকমতো সার আমদানি হয়নি। আবার গ্যাসের সঙ্কটে পাঁচটি কারখানার চারটিই বন্ধে হয়ে যায় (যদিও পরে দু’টি চালু হয়)। এর প্রভাবে জুলাই, আগস্ট এবং নভেম্বরে চাহিদার চেয়ে কম সার সরবরাহ করেছে বিসিআইসি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (গত জুলাই থেকে) ইউরিয়া সার আমদানি হয়েছে পাঁচ লাখ ১৫ হাজার মে. টন এবং উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার মে. টন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এখন সারের সঙ্কট হলে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যাবে। এখন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের মূল সময়। এ ছাড়া চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় বোরো মৌসুম শুরু হয়েছে। মাঠে রয়েছে আলু ও পেঁয়াজের মতো ফসল যেগুলো সারা বছরের ব্যবহারযোগ্য মজুদ গড়ে দেয়।
সারের বাড়তি দাম ইউরিয়া, নন-ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দিয়ে থাকে সরকার। এ জন্য এই সারগুলোর দামও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু সারা দেশেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে, যদিও কিছু ডিলার, বিক্রেতাকে আইনের আওতায়ও আনা হয়েছে। পঞ্চগড়, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, রাজশাহী, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের জেল-জরিমানা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে, খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় প্রতি কেজিতে দুই-তিন টাকা করে তারা বেশি নিচ্ছেন। কৃষকরাও বাধ্য হচ্ছেন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার কিনতে। অনেকের মধ্যে সারসঙ্কটের ভীতিও কাজ করছে। ফলে অগ্রিম সার কিনে রাখার কারণেও বাজারে প্রভাব পড়ছে বলে জানা যায়।
তবে, দেশে কোনো সারের সঙ্কট নেই বলে জানান কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। তিনি বলেন, কোথাও সরবরাহ এক-দু’দিন দেরি হলেই সেখানে একটা ক্রাইসিস তৈরির চেষ্টা হয়। সচিব বলেন, বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ উঠছে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কঠোরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে একেবারে খুচরাপর্যায় পর্যন্ত ম্যানেজ করাটা কঠিন। আবার অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সার কেনার জন্য ভিড় করছে, এটাও একটা সঙ্কট। কেউ যদি সারের দাম বেশি নেন কৃষি অফিসে অভিযোগ করলে সাথে সাথেই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে ৫৩ নাগরিকের উদ্বেগ ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দুর্নীতি কে প্রশয় দেয়া হবে না : জাতীয় নাগরিক কমিটি ফতুল্লা থেকে অপহৃত ২ শিশু বরিশাল থেকে উদ্ধার মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করা শিক্ষককে চাকরিচ্যুতের দাবি টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দিবসে রিকের র‌্যালি ও মানববন্ধন অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সভাপতি হাসান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল চুয়েটে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ঢাকায় উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার না করতে ডিএমপির নির্দেশনা তামিমের ঝড়ে জয় পেল চট্টগ্রাম তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা, কর্মকর্তা প্রত্যাহার

সকল