ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সব গুম-খুনের বিচার দাবি
- ঢাবি প্রতিনিধি
- ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ‘গণহত্যা, গুম ও ভয়ের সংস্কৃতি, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচারের দাবি’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারে বক্তারা গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলের সব গুম ও খুনের বিচার দাবি করেছেন।
গতকাল বেলা ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের মোজাফফর আহমেদ অডিটোরিয়ামে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘সকল প্রাণের নিরাপত্তা- সপ্রাণ’ এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে কবি ফরহাদ মজহার, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ‘মায়ের ডাক’ এর সংগঠক সানজিদা তুলি, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা, মা ও বোন, মানবাধিকার কর্মী ও নৃবিজ্ঞানী মুশফিকুর রহমান জোহান, গুম ও মানবাধিকার বিষয়ক গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী ইসমত আরা বক্তব্য রাখেন।
মানবাধিকার কর্মী ও মুশফিকুর রহমান জোহান বলেন, গুম কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী গুমের সংখ্যা ১৬০০। আমার ধারণা এই সংখ্যাটা আরো বেশি। যারা দুই-তিন দিন গুম ছিল তারা নিজেদের গুম ভাবছে না। অনেকেই এখনো প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না ভয়ে।
শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা বলেন, জুলাই আন্দোলনে যে গণহত্যা চালিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার, এরকম গণহত্যা আমি আর দেখিনি। আমার ছেলেটার বুকে গুলি করা হয়েছে টার্গেট করে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাকে একটু ভালো করে চিকিৎসাও করতে দেয়নি। তিনি বলেন, আমাদের ছেলেরা যারা জীবন দিয়েছে তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। আর কোনো ফ্যাসিবাদ যেন এ দেশে আসতে না পারে।
ফারহান ফাইয়াজের বোন সাইমি ইসলাম ফারিন বলেন, যাদের কারণে আমার বাবা-মা তাদের ছেলেকে হারিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই। যেসব আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কারণে এত শহীদ হয়েছে আমি চাই তাদের যেন প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। এজন্য এখন আমাদের সবার উচিত ঐক্যবদ্ধ থাকা।
‘মায়ের ডাক’ এর সংগঠক সানজিদা তুলি বলেন, গুম, খুন আমাদের চোখেই সামনেই করা হচ্ছিল। কিন্তু পুরো দেশ চুপ ছিল। লেখক, সাংবাদিক যারাই কথা বলত তাদেরই গুম করে ফেলা হতো। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের জেলে দেয়া হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। কিন্তু আমরা কিছুই বলতে পারিনি। শাপলা চত্বরে হেফাজতের গণহত্যায় কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা কেউ জানে না। ইন্টারনেট, টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে এগুলো করা হয়েছে। জুরাইনে গণকবর দেয়া হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এই গণহত্যাটা থেমে থেমে হয়েছে। আমরা বলতে পারি এই স্বৈরশাসকের পুরো সময়টায় গণহত্যা চালানো হয়েছে। বিভিন্ন সময় যখন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল তখন যাদেরকেই সন্দেহ হচ্ছিল তাদেরকেই উঠিয়ে নেয়া হতো।
গুম কিভাবে করা হতো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, কাউকে কাউকে রাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্রিজে দুই পাশ বন্ধ করে গুলি করে ফেলে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো লাশ নিয়ে গিয়ে ট্রেন লাইনের ওপর রাখা হয়েছে। কাউকে কাউকে চলন্ত বাস বা ট্রাকের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে রাতে। ১৫ সালে একজন নারী কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তাকে উঠিয়ে নেয়া হয় তার সন্তানসহ। সন্তানকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয় কমলাপুরের কাছে। আর ভদ্র মহিলার এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সন্ধান জানি না।
কবি ফরহাদ মজহার, যখন গুম হয় তখন সেই পরিবারের লোকজন জানে না যে ওই ব্যক্তি বেঁচে আছে নাকি নেই। সেই পরিবারে ওই সময় যে অবস্থা সৃষ্টি হয় তা ভয়াবহ।
তিনি বলেন, আমি নিজেও গুম হয়েছিলাম। আমি ফিরে এসে দুবার চেষ্টা করেছি আত্মহত্যা করার। এটা সহ্য করা আসলেই কঠিন। এটা একটা ভয়ঙ্কর অনুভূতি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, পরিবার কিন্তু জানে না গুম হওয়া ব্যক্তিকে নিয়ে গেছে কোথায়, সেটা কি সত্য না মিথ্যা তা কিন্তু আমরা জানি না। এটা জানার যে চেষ্টা সেটা উপদেষ্টা সরকারের কাছ থেকে আমরা পাই নাই। যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আমাদের ক্ষুব্ধ করে। সত্য জানার অধিকার আমাদের আছে। তারা কি মরে গেছে, কে তাদের নিয়ে গেছে, কেন নিয়ে গেছে, কী তাদের ভুল ছিল এই সত্য জানার অধিকার জনগণের আছে।