১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হাসিনার জন্য তৈরি বিলাসবহুল অতিথিশালা এখন বোঝা

কর্ণফুলী টানেল এলাকায় বিলাসবহুল অতিথিশালা -

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল এখন শুধু প্রযুক্তির এক বিস্ময় হিসেবে চিহ্নিত নয়, বরং আর্থিক সঙ্কট এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের একটি উদাহরণ হিসেবেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে খুলে দেয়া এই টানেল নিয়ে শুরু থেকেই ছিল নানা সমালোচনা। বিশেষ করে এর প্রকল্প ব্যয় লাগামহীন বৃদ্ধি এবং অতিথিশালা নির্মাণের মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

টানেলের নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় একটি বিলাসবহুল অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি এই অতিথিশালায় রয়েছে পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের একটি আধুনিক বাংলো। এতে ৬টি কক্ষ, একটি সুইমিংপুল এবং সর্বাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রয়েছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্তে পারকি খালের পাশে অবস্থিত এই অতিথিশালাটি তৈরি করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য সফরকে সামনে রেখে। ধারণা করা হয়েছিল, শেখ হাসিনা আনোয়ারায় গেলে এই অতিথিশালায় অবস্থান করবেন।

তবে বাস্তবে অতিথিশালাটি কোনো দিন ব্যবহার হয়নি। সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটি চালু করার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই। অতিথিশালাটি নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এত ব্যয়সাপেক্ষ একটি স্থাপনা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল।

জানা যায়, টানেলের নির্মাণ প্রকল্পের একটি অংশ হিসেবে সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ করা হয়েছে। ৭২ একর জায়গা জুড়ে তৈরি এই এলাকায় অতিথিশালার পাশাপাশি রয়েছে আরও ৩০টি বিশ্রামাগার, একটি সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে একটি জাদুঘর। এই পুরো এলাকাকে অত্যন্ত বিলাসবহুল এবং আধুনিকভাবে সাজানো হয়েছে।

অন্য দিকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে পর্যটন করপোরেশন ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটি আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে। এতে ১০টি সিঙ্গেল কটেজ, ৪টি ডুপ্লেক্স কটেজ, একটি বহুমুখী ভবন, হ্রদ এবং শিশুদের জন্য খেলার জায়গা থাকবে। এমন অবস্থায়, টানেল প্রকল্পের অতিথিশালার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আরো বড় প্রশ্ন উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেলটি চালু হওয়ার পর আশানুরূপ যানবাহন চলাচল হচ্ছে না। ২০২৩ সালের অক্টোবরে দৈনিক গড়ে মাত্র সাড়ে তিন হাজার যান চলেছে। অথচ প্রকল্প সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দিনে অন্তত ২০ হাজার যান চলবে। এই যানবাহন সংখ্যা প্রতি বছর ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল। যান চলাচল কম হওয়ায় টানেল থেকে টোল আদায়ের পরিমাণও অনেক কম। মাসে টোল আদায় হচ্ছে গড়ে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। ফলে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৯ কোটি টাকার ঘাটতি হচ্ছে।

জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। চীনের অর্থায়নে এবং তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে প্রকল্প চলাকালে জমি অধিগ্রহণ, শুল্ককর বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন পরিষেবা স্থানান্তরের জন্য তিন দফায় ব্যয় বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত টানেলের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়।

এ ছাড়া, অতিথিশালা এবং অন্যান্য অবকাঠামো যুক্ত করার সময় জরুরি ভিত্তিতে আরো ব্যয় বাড়ানো হয়। অতিথিশালার তৈজসপত্র, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী এবং আসবাবপত্র কেনার জন্য ব্যয় অনেক বাড়ে।
এ দিকে টানেলের লোকসান কমানোর জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এবং বান্দরবানমুখী বাসের টানেল ব্যবহার নিশ্চিত করা, আনোয়ারা প্রান্তের সরু সড়ক সম্প্রসারণ, আনোয়ারায় শিল্পায়ন এবং আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অতিথিশালাটি বেসরকারি খাতে পরিচালনা।

টানেলের এমন আর্থিক সঙ্কট এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ে সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, কর্ণফুলী টানেল এমনিতেই আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর পুরোপুরি ব্যবহার হবে না। টোল থেকে যে আয় হবে, তা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ খরচের এক-চতুর্থাংশও উঠবে না। এর মধ্যে অতিথিশালা নির্মাণের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। মূলত প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের জন্য এসব করা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহাইব নয়া দিগন্তকে বলেন, এই প্রকল্প যখন করার কথা হচ্ছিল তখনই অর্থনীতিবিদের কেউ কেউ বলেছিলেন যে এটা একটা সাদা হাতি হতে যাচ্ছে। এই টানেল হবার আগে বলা হয়েছিল যে, আনোয়ারায় চায়না ইকোনমিক জোন এবং বাঁশখালীর সমুদ্র তীর ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে টানেলের উপযোগিতা বাড়বে এবং টানেল থেকে প্রত্যাশিত আয় উঠে আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেই ইকোনমিক জোন এবং আনোয়ার-বাঁশখালীর সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না বাড়ায় টানেল এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপরে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সাত তারকা মানের বাংলো। এ ধরনের প্রকল্পে ৭ তারকার মাসের বাংলো করার উপযোগিতা আমার বোধগম্য নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে বিগত আমলে প্রকল্পের নামে যে দুর্নীতির মহোৎসব চলেছে তার একটা চিত্র হচ্ছে এই বাংলো।

সমালোচনা করছেন রাজনীতিবিদরাও। সাবেক এমপি ও চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি অসংলগ্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে এই টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের লুটপাটের সুবিধার জন্য জনগণের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা না করে এত বড় বাজেটে এই টানেল নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান কর্ণফুলী টানেল পরিদর্শন শেষে আমাদের সাথে মিটিং করেছেন। সেখানে তিনি টানেলের আয়-ব্যয় নিয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। কিভাবে আর্থিক লস কাটিয়ে ওঠা যায় সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভাবছে। যারা টানেলের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে তাদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন সাবেক এই হুইপ।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, টানেল প্রকল্পের এমন আর্থিক সঙ্কট এবং পরিকল্পনার ত্রুটিগুলো সরকার এবং জনগণের জন্য বড় শিক্ষা। অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের আগে এর যৌক্তিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প শুধু আর্থিক ক্ষতির উদাহরণ নয়, বরং অব্যবস্থাপনার একটি প্রতিচ্ছবিও। এখন সরকারের উচিত ভবিষ্যতের জন্য আরও সুপরিকল্পিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। এসব ব্যাপারে কর্ণফুলী টাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement
মানবসেবার জন্যই হাসপাতাল করেছি : জামায়াত আমির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের আয়কর নথি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত চট্টগ্রামে সাবেক এমপি মোতালেবসহ ২৪৮ জনের নামে মামলা চিন্ময়ের জামিন শুনানি জানুয়ারিতেই ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, শুরু ১০ এপ্রিল ডেঙ্গুতে আরো ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৪৪ ধবলধোলাই এড়াতে ৩ পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ নববর্ষের প্রকাশনা ইসলামী শ্রমনীতির প্রচারে ভূমিকা রাখবে : শামসুল ইসলাম ‘শেখ হাসিনা দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করতে চায়’ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা ই-সিগারেটকে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত

সকল