পাঠ্যপুস্তক পরিদর্শনের কাজ পাচ্ছে ভারত নিয়ন্ত্রিত বিতর্কিত কোম্পানি
সর্র্বনিম্ন দরপত্র জমা দিয়েও বাদ পড়েছে দেশীয় ৫ প্রতিষ্ঠান- শাহেদ মতিউর রহমান
- ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অবশেষে দরপত্রের বিধি লঙ্ঘন করে পাঠ্যপুস্তক পরিদর্শনের কাজ পাচ্ছে অনিয়মের দায়ে জরিমানায় অভিযুক্ত ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত ফরাসি কোম্পানি ব্যুরো ভেরিতাস। যদিও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে পাঠ্যপুস্তক পরিদর্শন কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ ও অন্যান্য উপকরণেরও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এর পরও কেন এবং কিভাবে তারা পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের দায়িত্ব পাচ্ছে তা নিয়েও শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠেছে।
অন্য দিকে সর্বোনিম্ন দরপত্র জমা দিয়েও পাঠ্যপুস্তক পরিদর্শনের কাজ পায়নি দেশের শীর্ষ পাঁচটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে কয়েক গুণ বেশি দর দেয়ার পরও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিনামূল্যের পাঠ্যবই পরিদর্শনের কাজ ভাগিয়ে নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত ফরাসি এই কোম্পানি।
সূত্র জানায়, ভারতীয় এই কোম্পানি গত তিন বছর আগে প্রাথমিকের পাঠ্যবই পরিদর্শন কাজে অনিয়মের কারণে বড় অংকের অর্থ জরিমানা দিয়েছিল। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেই সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) থেকে ব্যুরো ভেরিতাসকে আর্থিকভাবে জরিমানাও করেছিল। কিন্তু চলতি বছরে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে মাধ্যমিকের ৩১ কোটির বেশি বিনামূল্যের পাঠ্যবই পরিদর্শনের কাজ ভাগিয়ে নিয়েছে এ বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরে মাধ্যমিকের পাঠ্যবই পরিদর্শনের জন্য দুই পর্বে পিডিআই (প্রি ডেলিভারি ইন্সপেকশন) এবং পিএলআই (পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন ) কাজের জন্য এনসিটিবির দেয়া টেন্ডার অনুযায়ী অংশ নেয় মোট ৬টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে পিডিআই কাজের জন্য অপেক্ষাকৃত কম দরপত্র জমা দেয় ইন্ডিপেনডেন্ট বিডি, শেখ ট্রেডিং বিডি, ইনফিনিটি বিডি, কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডি এবং হাইটেক বিডি। এর মধ্যে হাইটেক বিডির দর ছিল তিন লাখ ৯৯ হাজার টাকা, কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডির ৯ লাখ, ইন্ডিপেনডেন্ট বিডির ১৫ লাখ, শেখ ট্রেডিংয়ের ১৯ লাখ এবং ইনফিনিটির দেয়া দর ছিল ২০ লাখ ৬০ হাজার ৪২২ টাকা। অপর দিকে ভারতীয় কোম্পানি নামে পরিচিত ব্যুরো ভেরিতাসের দেয়া দর ছিল সবগুলো কোম্পানির মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৩৫৫ টাকা ৭৪ পয়সা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এনসিটিবি থেকে পিডিআই কাজের জন্য রেসপন্সিভ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ দরদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যুরো ভেরিতাস কোম্পানিকে সুপারিশ করা হয়েছে।
যদিও এনসিটিবি থেকে বলা হয়েছে ব্যুরো ভেরিতাস ভারতীয় কোনো কোম্পানি নয়, এটা ফরাসি কোম্পানি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে ব্যুরো ভেরিতাস নামের এই কোম্পানির গত বেশ কয়েক বছর ধরেই টেন্ডারে অংশ নেয়া থেকে শুরু করে টেন্ডারের রেট কোটেশন সব যাবতীয় কার্যক্রম ভারত থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে। সূত্র আরো জানায়, ব্যুরো ভেরিতাসের দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারতের অমিত ঘোষ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিই মূলত ভারতে থেকেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ব্যুরো ভেরিতাসের এজেন্সিশিপ নিয়ে এসে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
এ দিকে টেন্ডারে অংশ নেয়া সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে তারা নয়া দিগন্তকে এই প্রতিবেদককে জানান, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তারা পাঠ্যবই পরিদর্শনের কাজ দক্ষতার সাথে করে আসছেন। চলতি বছরও এনসিটিবি থেকে ল্যাবসহ ও অন্যান্য অবকাঠামো পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করে তাদেরকে যোগ্য হিসেবে যথাযথ প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে। এমনকি বিগত বছরের পাঠ্যবই পরিদর্শনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবেও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে (ইন্ডিপেনডেন্ট বিডি, শেখ ট্রেডিং এবং ইনফিনিটি বিডি) এনসিটিবি থেকেই কাজের দক্ষতা সনদ (পারফরম্যান্স সার্টিফিকেট) দেয়া হয়েছে।
এনসিটিবির অন্য একটি সূত্র জানায়, ব্যুরো ভেরিতাসকে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে টেন্ডারের বেশ কিছু শর্তও লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিশেষ করে টেন্ডার শিডিউলের ১৪ নং পৃষ্ঠায় ITT Clause ১৪.১ এ বলা আছে All testing machineries must be calibrated by any Govt. Organization. Machine Calibration Certificate must be up to date for all machineries এবং ২০.১(শ) ১০ No. তে বলা আছে Updated Machine Calibration Certificate.
অভিযোগ রয়েছে ব্যুরো ভেরিতাসে সব ক্যালিব্রেশন সার্টিফিকেট পুরাতন যার তারিখ এডিট করা হয়েছে। আবার সরকারিভাবে তিনটি মেশিনের ক্যালিব্রেশন করা যায় বাংলাদেশে বিশেষ করে ১. থিকনেস মেশিন ২. জিএসএম মেশিন ৩. ওভেন। এই তিনটির মধ্যে ব্যুরো ভেরিতাসের একটি মেশিনও নেই । পাশাপাশি তাদের অবকাঠামো পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে তাদের ২-৩টা মেশিনও বর্তমানে তাদের সংরক্ষণে নেই। কিন্তু Tender Schedule এর ১৪ নং পৃষ্ঠায় ITT Clause ১৪.১ এ স্পষ্ট করে বলা আছে The Tenderer Shall have Own Testing Laboratory and Own Testing machineries (Balance, Gloss Tester, Stiffness Tester, Brightness Tester, Bursting Strength Tester, Opacity Tester, Microscope, Thickness Tester, Oven, Stop Watch, Sizing Tester) to perform all necessary tests of paper and cover as mentioned in Annexure A and B
এ দিকে সর্বনিম্ন দরদাতা থাকার পরেও কেনো সর্বোচ্চ দরদাতাকে পাঠ্যপুস্তক পরিদর্শনের কাজ দেয়া হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা দরপত্রের মাধ্যমে ৬টি কোম্পানি থেকে যে দর পেয়েছি সেখানে সবাই অনেক কম দর জমা দিয়েছেন। কয়েকটি কোম্পানিতো প্রাক্কলিত দরের চেয়েও অনেক কম দর জমা দিয়েছেন। তারা তো প্রকৃত অর্থে কাজ করার জন্য এই দর জমা দেয়নি। হয়তো তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে আমরা মন্দের ভালো করতে গিয়েই সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দিয়েছি। তার পরেও যে কোম্পানি কাজ পেয়েছে তারাও প্রাক্কলিত দরের চেয়েও কম দর জমা দিয়েছে। এ ছাড়া এনসিটিবির বিকল্প আর কোনো উপায়ও ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যুরো ভেরিতাস ভারতীয় কোনো কোম্পানি নয়। এটা ফরাসি একটি কোম্পানি। তবে ব্যুরো ভেরিতাসের নিজস্ব কয়েকটি মেশিন এই মুহূর্তে নেই এমন তথ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান নিজেই। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, ব্যুরো ভেরিতাসের যে মেশিনটি এই মুহূর্র্তে নেই সেটি তারা চায়না থেকে নিয়ে আসতেছে বলে আমাদের জানিয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন কোনো কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য কোনো ধরনের সুবিধা নেয়ার বিষয়টি একেবারেই অবান্তর। এখন যে বা যারা এমন অভিযোগ করছে তারাই বরং আমাদের কাছে নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা দেয়ার কথা বলে কাজ পাওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা তদবিরও করেছেন।