বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও কেনিয়া অভিজ্ঞতায় বিদ্যুৎ রফতানি থেকে পিছু হটছে আদানি
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশের জন্য উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারতে বিশেষ ছাড়ে বেচতে চায় আদানি পাওয়ার। বাংলাদেশের কাছে আদানি প্রায় ১৫ টাকা ইউনিটে বিদ্যুৎ রফতানির চুক্তির পর এখন এর চেয়ে অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হবে আদানিকে। কারণ ভারতে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউনিট ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে বিদ্যুতের দামে তারতম্য রয়েছে। বাংলাদেশের মত এত সহজে আদানি ভারতে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে না। ভারতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ সাড়ে ৬ থেকে ৭ রুপির কিছু বেশি পড়লেও ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের মূল্য ইউনিট ব্যবহারের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে তা ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করা হয়। ভারতে, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো এত সহজে সরকার চাইলেই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে না।
দ্য হিন্দু বিজনেস লাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আদানি পাওয়ার লিমিটেড বিজেপি সরকারের কাছে বিশেষ ছাড় চাচ্ছে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য। কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কায় আদানির বিনিয়োগ পর্যালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশ তা অনুসরণ করায় ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ রফতানিতে সুবিধা করতে পারবে না বলে মনে করছে আদানি।
ভারতে গ্রাহককে ৪০১ থেকে ৫০০ ইউনিটের জন্য প্রতি ইউনিট ৬.৫০ টাকা এবং ৫০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য প্রতি ইউনিট ৮ টাকা, ৬০০ ইউনিটের ওপরে এবং ৮০০ পর্যন্ত, প্রতি ইউনিট ৯ টাকা দিতে হয়। ৮০১ থেকে ১,০০০ ইউনিটের জন্য প্রতি ইউনিট ১০ টাকা এবং ১,০০০ ইউনিটের ওপরে ইউনিটের জন্য ১১ টাকা ধার্য করা হয়। অথচ আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা ৮৫ পয়সায় রফতানির চুক্তি করেছে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি বিশেষ ছাড় না দেয়, আদানিকে কয়লা আমদানি ও বিদ্যুতের ওপর কর দিতে হবে। আদানি কয়লা আমদানির জন্য শুল্কমুক্তি সুবিধা চাচ্ছে। এই সুবিধা ছাড়া ভারতের বাজারে বিদ্যুতের যে দাম তার চেয়ে বেশি হয়ে যাবে আদানির বিদ্যুতের দাম। তবে বাংলাদেশের বকেয়া বিষয়ে আদানি পাওয়ারের ইনভেস্টর রিলেশনের প্রধান নিশিত দাভে বলেন, আশা করি, বকেয়া পরিস্থিতি আর খারাপ হবে না এবং এই মুহূর্তে আমরা মনে করি না যে, আমাদের অন্য কোনো বিকল্প খুঁজতে হবে। তবে প্রয়োজন হলে আমরা এই বিষয়ে চিন্তা করব। আমরা বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করব।
বিদ্যুতের মূল্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আড়াইশ মিলিয়ন ডলার ঘুষের অভিযোগ এবং বাজারে আদানির বিপক্ষে তীব্র বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়ায় ভারতে দ্রুত করপোরেট বৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে আদানি আর স্বীকৃত নয়। আন্তর্জাতিক বিশ্ব ছাড়াও অন্তত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও কেনিয়ার নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা আদানি সম্পর্কে ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নিতে নড়েচড়ে বসছেন। তারা আদানির সাথে চুক্তিগুলো সংশোধন বা বাতিলের কথা ভাবছেন। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি বাতিলের বিবেচনা করছে।
শ্রীলঙ্কার ডেইলি মিররের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, আদানি গ্রুপের বিশ্বব্যাপী যাচাই-বাছাই শ্রীলঙ্কার ওপর বড় চুক্তির পুনর্বিবেচনার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। আদানি এমন এক বিতর্কের ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে যা শ্রীলঙ্কায় উল্লেখযোগ্য প্রকল্পসহ এর বৈশ্বিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। আদানির আইনি এবং আর্থিক সমস্যাগুলো শ্রীলঙ্কায় এর কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ এবং দেশটির অবকাঠামোগত উচ্চাকাক্সক্ষার প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। কারণ অভিযোগগুলো প্রকাশের পর আদানি গ্রুপ তার তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর বাজারমূল্যে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আদানি গ্রীন এনার্জি বাজারমূল্যে একাই হারিয়েছে প্রায় ৯.৭ বিলিয়ন ডলার।
বিজেপি দাবি করেছে গান্ধী, ওসিসিআরপি এবং ৯২ বছর বয়সী বিলিয়নিয়ার ফিনান্সার-জনহিতৈষী জর্জ সোরোসকে আদানি গ্রুপ এবং মোদি সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য অভিযুক্ত করেছে, যা ভারতেকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা। তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বিজেপির এ ধরনের অভিযোগকে ‘হতাশাজনক’ অভিহিত করে বলেছে, মোদিকে টার্গেট করতে, ভারতকে অস্থিতিশীল করতে ওয়াশিংটন এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব
আদানির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘুষ দেয়ার অভিযোগের ফল ভারতের বাইরেও প্রসারিত। মুডিস এবং ফিচসহ প্রধান আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলো প্রশাসনের উদ্বেগ, তহবিল ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য অপারেশনাল ব্যাঘাতের উল্লেখ করে আদানির ওপর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক করেছে। ফিচ আদানি এনার্জি এবং আদানি ইলেকট্রিসিটি মুম্বাইকে নেতিবাচক নজরে রেখেছে, মুডিস আদানি পোর্টস এবং এসইজেডসহ গ্রুপের সাতটি কোম্পানিকে স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক পর্যায়ে নামিয়েছে।
ফ্রান্সের বৃহত্তম বিনিয়োগকারী টোটাল এনার্জি আদানি গ্রুপে বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে। একটি মার্কিন উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে শ্রীলঙ্কায় আদানির তৈরি বন্দরে এর তহবিল চুক্তি পর্যালোচনা করবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ আদানির বিদ্যুৎ নেয়ার ক্ষেত্রে চুক্তির শর্তাবলী পর্যালোচনা করার ইঙ্গিত দিয়েছে। কেনিয়ায় আদানির বিমানবন্দর এবং পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইন প্রকল্পগুলোতে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের একটি ক্রয় প্রক্রিয়া বাতিলের আদেশ দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থার দৃষ্টিতে নেতিবাচক পরিবর্তন আদানির মূলধন সংগ্রহ ও উচ্চাভিলাষী সম্প্রসারণ পরিকল্পনাগুলো পূরণ করার বিষয়ে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি প্রতিফলিত করে, বিশেষ করে চলমান আইনি চ্যালেঞ্জের কারণে। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এখন আদানি গ্রুপ থেকে সতর্ক এবং বড় স্টেকহোল্ডাররা তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে।
শ্রীলঙ্কায় কলম্বো পোর্ট টার্মিনাল এবং মান্নার বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে আদানির বিনিয়োগে স্বচ্ছতা, শাসনব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কলম্বো বন্দর প্রকল্প, যেখানে আদানি পোর্টের একটি বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে, ঘুষের অভিযোগের পরে এটি বিশেষভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিক এবং কর্মী সোসাল মিডিয়ায় আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ প্রকল্পে আরো বেশি তদন্তের দাবি তুলেছেন। আদানি গ্রীন এনার্জি উত্তর শ্রীলঙ্কার মান্নার এবং পুনেরিনে একটি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে যে ৪৪২ মিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে তাতে দরপত্র ছাড়াই ‘ব্যাকডোর এন্ট্রি’ অভিযোগে প্রকল্পটি বিতর্কিত রয়ে গেছে। সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের (সিইবি) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা একটি সংসদীয় প্যানেলকে বলেছিলেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে ‘চাপ’ দেয়ায় প্রকল্পটি আদানি গ্রুপকে দেয়া হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজ গোষ্ঠীগুলো শ্রীলঙ্কার পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি খাতে আদানির জড়িত থাকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কেউ কেউ যুক্তি দেন যে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত একটি কোম্পানিকে এই ধরনের হাই-প্রোফাইল প্রকল্পগুলো প্রদান করা শ্রীলঙ্কার আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে কলঙ্কিত করতে পারে এবং অন্যান্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের বাধা দিতে পারে। শ্রীলঙ্কায় পাবলিক স্ক্রুটিনিও বাড়ছে। ভেরিটে রিসার্চের নিশান দে মেলসহ বিশেষজ্ঞরা, শ্রীলঙ্কাকে অতীতের দুর্নীতির ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য এবং আদানি বা অন্য কোনো বিদেশী বিনিয়োগকারীর সাথে কোনো চুক্তিই দেশের অখণ্ডতা বা জনগণের কল্যাণে আপস না করে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।