০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

অস্থিরতা দূর করতে বাড়ছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন

-

- নেতাদের দাবি ১২ শতাংশ
- মালিকরা দিতে চাচ্ছেন ৭ শতাংশ

দেশের পোশাক খাতে অস্থিরতা দূর করতে বাড়ছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতাদের দাবি বেতন বাড়াতে হবে ১২ শতাংশ। অপর দিকে গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন ৭ শতাংশের বেশি বেতন তারা বাড়াতে পারবেন না। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন পরিমাণ যাই হোক শেষ পর্যন্ত গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বাড়বে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের গার্মেন্ট খাতে অব্যাহতভাবে চলছে অস্থিরতা। গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবি বাড়াতে হবে তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। এসব দাবি বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে অস্থিরতা তৈরি করে যাচ্ছে গার্মেন্ট শ্রমিকরা। এ সুযোগ নিচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীরা। গার্মেন্ট খাতে অস্থিরতা দূর করতে নেয়া হয়েছে একগুচ্ছ পদক্ষেপ। এরই অংশ হিসেবে বাড়ানো হচ্ছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা।
বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অতিরিক্ত আরো ২ শতাংশ বাড়াতে রাজি হয়েছেন তৈরী পোশাক শিল্পের মালিকরা। গার্মেন্ট মালিকরা নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত পোশাক শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি নিয়মিত ৫ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ, অর্থাৎ ৭ শতাংশ বাড়াতে চান। যদিও শ্রমিকরা এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তারা চান, বার্ষিক ১২ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি।

এ দিকে গত মঙ্গলবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বৈঠকে তৈরী পোশাক (আরএমজি) কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। কারখানা মালিকরা বেতন ৭ শতাংশ বাড়াতে চান। অপরদিকে শ্রমিক নেতাদের দাবি বেতন বাড়াতে হবে ১২ শতাংশ।
ন্যূনতম মজুরি পুনর্মূল্যায়ন ও বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির চতুর্থ বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। সচিবালয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অতিরিক্ত সচিব সবুর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মালিক ও শ্রমিক পক্ষের ছয়জন প্রতিনিধি।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ নিজেদের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। মালিক পক্ষ ৭ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে রাজি আছে জানালে শ্রমিক পক্ষ আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ১২ শতাংশ দাবি করে। প্রথমে শ্রমিক পক্ষ অতিরিক্ত ১০ শতাংশসহ মোট ১৫ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিল। শ্রম মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির তৃতীয় বৈঠকে মালিক পক্ষ নিয়মিত ৫ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ১ শতাংশসহ মোট ৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। তবে বৈঠকে শেষ পর্যন্ত বার্ষিক মজুরি কত শতাংশ বাড়বে, সেই বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় আগামী সপ্তাহে শ্রমসচিবের সভাপতিত্বে আবারও কমিটির বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির সদস্য এ এন এম সাইফুদ্দিন ও বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মহাসচিব ফারুক আহাম্মাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুব বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি কবির আহম্মেদ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলি শামীম এহসান নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা ৭ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। সর্বশেষ এক বছর আগে ৫৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সাথে বার্ষিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়েছে এক বছর আগে।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের পোশাক শিল্প বার্ষিক ৭ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি বহন করতে সক্ষম হবে না। কারণ উৎপাদন ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। একই সাথে কমেছে পোশাকের দাম। মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে শ্রমিকরা লাভবান হবে না। বেসরকারি খাত এর দায় নিতে পারবে না বলেও দাবি করেন ব্যবসায়ী নেতা। দেশে মোট কারখানার ৬০ শতাংশ নিয়ে গঠিত ছোট এবং মাঝারি আকারের ইউনিটগুলো কাজের আদেশ হ্রাসের কারণে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে এমন সময় বড় কারখানগুলো বেশ ভালো কাজের অর্ডার পেয়েছে।
ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা ও বার্ষিক বৃদ্ধি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য শামীম বলেন, তারা গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য রেশনিং চালু করতে এবং শিল্পাঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা মজুরি বার্ষিক ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেন, শ্রমিকদের মজুরি ঐতিহাসিকভাবে একটি সাধারণ জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। সর্বশেষ পর্যালোচনা করে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপের মধ্যে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বেতন যথেষ্ট ছিল না।
তিনি বলেন, ২০০৬ সাল থেকে বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্টের সময় মালিকরা সবসময়ই শিল্পের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কয়েক বছর ধরে রফতানি আয় বৃদ্ধির সঙ্গে শিল্পের সক্ষমতা বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে একজন প্রবেশ-স্তরের পোশাক শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা। গত ডিসেম্বর থেকে নতুন এ বেতন কাঠামো কার্যকর হয়েছে। এর আগে ছিল ৮,০০০ টাকা। এর আগে, শ্রমিক অসন্তোষ মোকাবেলায় সম্মত হওয়া ১৮ দফা দাবির দুটি প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে।

সাম্প্রতিক সময়ে আশুলিয়ায় শুরু হওয়া শ্রমিক অস্থিরতা গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক অস্থিরতা পোশাক শিল্পের রফতানিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এতে কাজের অর্ডার অন্য দেশে চলে যায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্যে দেখা যায় মজুরির বকেয়া পরিশোধ, বোনাস প্রদান এবং বেতন বৃদ্ধিসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান গার্মেন্টস শিল্প অঞ্চলে ৯৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগই আশুলিয়া এবং গাজীপুরে ঘটেছে।
পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) এর তথ্যানুসারে গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতার কারণে আনুমানিক ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখনো অস্থিরতার কারণে গার্মেন্টস খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সেটি নিরূপণ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে আমাদের কাছে আসা প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা আরো বাড়তে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার কারণে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

দেশের পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতায় প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার কাজের অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হয়েছে, যা দেশের মোট পোশাক রফতানির ৫ থেকে ৬ শতাংশ। তবে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গার্মেন্ট খাতে স্থিতিশিলতা বিরাজ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
তবে দেশের পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন তৈরী পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতারা আগামী বছরের কার্যাদেশ নিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ও প্রধান শিল্প অঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে নতুন কাজের অর্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে যে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছিল তা অনেকাংশ কেটে গেছে। এমনটাই জানিয়েছে গাার্মেন্ট খাতের ব্যবসায়ীরা।


আরো সংবাদ



premium cement