নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাওয়া আরমানের শরীরে ৮ বার অস্ত্রোপচার
- বাসস
- ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০২
দিনমজুর কিশোর রমজান আলী আরমান। বয়স ১৫ বছর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে অনিশ্চিত জীবন পার করছে। জীর্ণশীর্ণ ছোট্ট শরীরে এরই মধ্যে অস্ত্রোপচার হয়েছে আটবার। এক সময় নাড়িভুঁড়িতে তো অন্য সময় প্রস্রাবের রাস্তায়, আবার কোনো সময় তলপেটে অপারেশন হয়েছে ছোট্ট আরমানের। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় কষ্টে কেটেছে অনেক দিন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে নানার বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চন নগরে চলে গেছেন আরমান ও তার মা হীরা আক্তার (৩৮)।
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আরমান। ছররা গুলিতে তার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গেছে। কোমরে ও ঊরুতে গুলি লাগে তার। মলদ্বার বাইপাস করা হয়েছে। গুলিতে ইউরিনারি বর্ডারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তার চিকিৎসায় চড়া সুদে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন রিকশাচালক পিতা মো: মনসুর (৪৫)। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের পেছনেই সেই টাকা শেষ। এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে পুরো পরিবার।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা চিকদাইর নোয়াহাট এলাকায় স্থায়ী নিবাস হলেও নগরের মুরাদপুর এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক শোরুমের পেছনে মোহাম্মদপুর এলাকায় মাসিক ছয় হাজার টাকার ভাড়া বাসায় দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন মনসুর। আরমানের মা হীরা আক্তার। বয়স ৩৭ বছর। আরমানের বড় ভাই আরাফাত উল্লাহ (১৮) বাকপ্রতিবন্ধী। আরমান মাদরাসায় পড়াশোনা করত। অভাবের সংসারে পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি।
আরমান নগরের মির্জাপুর এলাকায় সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল তৈরির একটি কারখানায় দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কাজ করত। ঘটনার দিন সে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে ঝালমুড়ি খেতে মায়ের কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলো। হীরা আক্তার বাসসকে বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, আরমান আর ফিরে আসে না। সন্ধ্যার দিকে বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হীরার কানে ভেসে আসছিল। ছেলে ঘরে ফিরে না আসায় চিন্তা বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছেলের খোঁজে বাসা থেকে বের হন হীরা। পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানায় গিয়ে ছেলের ছবি দেখায় দায়িত্বরত পুলিশদের। আরমানের কোনো হদিস পাচ্ছিলেন না হীরা। রাত ৮টার দিকে স্বামী-স্ত্রী দু’জন যান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু কেউ আরমানের খোঁজ দিতে পারছিলেন না।
হীরা আরো জানান, তার বড় ছেলে আরাফাত উল্লাহ চান্দগাঁও থানাধীন বলিরহাট এলাকার একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) সন্ধ্যার পর কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে বহদ্দারহাট মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা কৌতূহলবশত নিজের মোবাইল ফোনের ভিডিওতে ওই ছবি ধারণ করে আরাফাত। পরদিন আরাফাত ভিডিওটি তার খালাকে দেখায়। সেখানে ভিডিও ধারণ করার সময় আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে এক শিশুকে বলতে শোনা যায় ‘তোমার ভাইয়ের পেটে গুলি লেগেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে’। ওই শিশু আরমান ও আরাফাতকে চিনত।
১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বলির হাটে গিয়ে ওই শিশুর সন্ধান পান হীরা। আগের দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে বহদ্দারহাট এলাকায় আরমান কিভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল এবং কারা তার ছেলেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছেন সে বিষয়ে হীরা আক্তারকে জানায় শিশুটি। এরপর দুপুর ১২টার দিকে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে গিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ সন্তানের সন্ধান পান হীরা। কিন্তু সেদিন হাসপাতালের বেডে অচেতন অবস্থায় আরমানকে দেখে জ্ঞান হারান হীরা আক্তার। চিকিৎসকেরা সেদিনই হীরাকে জানান, গুলিতে আরমানের পেটের নাড়িভুঁড়ি ও প্রস্রাবের রাস্তা ছিঁড়ে গেছে।
হীরা আক্তার জানান, সাত দিন পর ক্যাজুয়ালিটি বিভাগ থেকে ছেলের ছাড়পত্র পান তিনি। বাসায় ফিরে যাওয়ার পাঁচ দিন পর আরমানের পা দু’টি অবশ হয়ে যায়। এরপর চমেক হাসপাতালের ২৫ নং, ৭৯ নং ও ২৭ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলে আরমানের। ২২ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন সার্জারি ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে। এরপর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে তার নানার বাড়ি গিয়ে উঠেছেন হীরা আক্তার।
ছেলের চিকিৎসার খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে হীরা আক্তার জানান, তিনি আগে গার্মেন্টে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে দেখাশোনার জন্য ওই চাকরি তিনি ছেড়ে দেন। তার স্বামী রিকশাচালক। কিন্তু তিনি নানা রোগশোকে আক্রান্ত। বড় ছেলে বাকপ্রতিবন্ধী। ‘ছেলের নানা পরীক্ষা, ওষুধ কেনার পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে ৫০ হাজার টাকা। সংসারে তো অভাব। সুদের বিনিময়ে নেয়া ৫০ হাজার টাকাও শেষ’ হতাশার সুরে বলেন হীরা আক্তার।
হীরা জানান, অভাবের সংসারে করুণ দৈন্যে কাটছে তাদের জীবন। তবে চমেক হাসপাতালে নিয়মিত এসে ভগ্নিপতি মামুন তার ছেলে আরমানের খোঁজ নেন। কিন্তু অর্থসঙ্কটেই তারাও এখন কাহিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। তারা চান, সরকারি কিংবা বেসরকারি যেকোনো দিক থেকে কেউ তাদের সাহায্য করুক। না হলে পরিবার নিয়ে দুর্দশার অন্ত থাকবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা