২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক উদ্ধারের পরিবর্তে অধঃপতনের তৎপরতা

-


আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ অবস্থানে চলে যাচ্ছে। ব্যাংকটির মূলধন ভেঙে খাওয়া হচ্ছে। জামানতের জমি কম দামে বিক্রি, বিধিবহির্ভূত ব্যয়সহ নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাংকটির এমডিকে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। সর্বশেষ এমডিকে স্বপদে বহাল রাখতে পর্ষদের প্রস্তাবনাও নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও বহাল তবিয়তে আছেন এমডি শফিক বিন আব্দুল্লাহ। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে বিভিন্ন নথিতে স্বাক্ষরসহ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বপদে বহাল থাকার জন্য এখন তার পক্ষে স্বাক্ষরতা অভিযান চালানো হচ্ছে কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে দিয়ে। নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে এমডির পক্ষে স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে ব্যাংকটির সাধারণ কর্মকর্তা কর্মচারীদের-এমন অভিযোগ উঠেছে এমডির বিরুদ্ধে। সাধারণ কর্মকর্তা কর্মচারীরা বলেছেন, দীর্ঘ ১১ বছর ধরে এমডির দায়িত্বে থাকা শফিক বিন আব্দুল্লাহ ডুবন্ত আইসিবি ব্যাংককে উদ্ধারের পরিবর্তে অধঃপতনে নিয়ে যাওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়া অধিবাসী মো: শফিক বিন আব্দুল্লাহকে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরে কয়েক ধাপে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছয় মাস করে এক বছর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বর। ব্যাংকটির পর্ষদ তাকে আবারো এক বছর চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছে। কিন্তু এমডির নামে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফেরত পাঠানো হয়। যা শেষ হয়েছে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়। চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পুনঃনিযুক্তির বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অব্যবহিত নিচের পদ হতে কোনো যোগ্য কর্মকর্তাকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পাঠানোর পর কর্তৃপক্ষ নতুন এমডি নিয়োগ দেয়নি, বরং এমডিকে পুনর্বহালের জন্য পর্ষদ থেকে নতুন প্রস্তাব পাঠনো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ২১ অক্টোবর তা নাকচ করে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর পরও এমডি দায়িত্ব না ছেড়ে বিভিন্ন নথিতে স্বাক্ষরসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এ কাজে সহযোগিতা করছে সাবেক এক পরিচালক হাসিমা বিন ইসমাইলসহ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের কিছু কুচক্রী মহল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হাসিমা বিনতে ইসমাইল এক সময় আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে ছিল। অনেক আগে তিনি পর্ষদ থেকে বের হয়ে গেছেন। কিন্তু এর পরও এমডি ও তিনি মিলে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। বর্তমান এমডি আওয়ামী লীগ আমলের কিছু দুর্বৃত্তদের বিগত দিনে বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন। তাদের কারো কারো সাথে এখনো এমডির সখ্য রয়েছে। তাদের নানা অপকৌশলেই এমডি এখন বহাল থাকার চেষ্টা করছেন।
এমডির অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা কর্মচারীদের পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে, নানা রকম চাপ প্রয়োগ করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে একজন নির্বাহী পরিচালককে দিয়ে তদবির করে এমডি স্বপদে বহাল থাকার চেষ্টা করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে বারবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এমডিকে দায়িত্ব ছাড়ার নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না।
ব্যাংক সূত্র জানায়, বিভিন্ন অপকর্ম ও অদক্ষতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এমডি পদে পুনর্বহালের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। এরপরও আওয়ামী লীগের কিছু দোসরদের পরামর্শে হাসিমা বিনতে ইসমাইলের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্যাংকে পর্ষদের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি আবার বিবেচনার জন্য আবেদন করছে। এদিকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পর্ষদের ওপর চাপিয়ে দেয়ারও অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকের বন্ধকীকৃত জমি আওয়ামী লীগ সমর্থিত কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকটির পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক যে, তাদের এমন কোনো সিকিউরিটিজ নেই, যার বিপরীতে অন্য ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারবে। আরো জানা গেছে, ব্যাংকটি ধাপে ধাপে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে আইসিবির বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল, কারণ তারল্য সঙ্কটে ব্যাংকটি কার্যত বন্ধ আছে। আর্থিক সঙ্কট নিরসনে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতহীন ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তার আবেদন করেছিল আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। তবে দুই সপ্তাহ পর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দায় ছিল।
সূত্র জানায়, এমডির আমলে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। তার গত ১১ বছরের দায়িত্বকালে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসান হয়েছে ব্যাংকটির। সর্বশেষ ২০২৩ সালে লোকসান হয় ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। একইসাথে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের রেডজোন তালিকায় রয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল এক হাজার ২১২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। ফ্রোজেন ডিপোজিট হলো-ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানত, যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে রেখেছিল। ব্যাংকটির ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল দুই হাজার কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement