২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণ চায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গতকাল বাকুতে কপ২৯-এর একটি ইভেন্টে বক্তৃতা করেন : পিআইডি -

জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন কপ ২৯ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) সম্মেলনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো বছরে ক্ষতিপূরণ চায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সম্মেলন শুরুর প্রথম দিন থেকেই প্যারিস চুক্তির আলোকে জলবায়ু অর্থায়নের জোর দাবি করেছেন অংশীজনরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে যেন অর্থসহায়তা বাড়ানো হয় সেই দাবিও জানানো হচ্ছে সম্মেলনে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেয়ার সক্ষমতা নেই, যেখানে দেশটির বছরে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের প্রয়োজন। এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা যাতে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকে শক্ত অবস্থান নেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক তহবিলগুলো থেকে অর্থ পেতে জলবায়ু প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি ও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলেছে। তারা উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যাতে তারা জলবায়ু অর্থায়ন বাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দেয়। এতে, অভিযোজন এবং প্রশমন প্রচেষ্টায় কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো জলবায়ু তহবিলের অ্যাক্সেস পাবে, যা আমাদের অভিযোজন সক্ষমতা আরো শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ২২ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এসডিসি) অঙ্গীকার করেছে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) পক্ষ থেকে বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের নতুন দাবি তোলা হয়েছে। এই অর্থায়ন আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাকু সম্মেলনে যোগ দেয়া প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণবিষয়ক লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ নয়া দিগন্তকে বলেন সম্মেলন শেষ হতে আর মাত্র দুই দিন বাকি। এখনো অর্থায়ন, তহবিল, অভিযোজন, খাদ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, লস অ্যান্ড ড্যামেজ এবং মানবাধিকার বিষয়ে বিশ্বনেতৃত্ব কোনো সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করেননি। তবে কেবল অঙ্গীকার ঘোষণার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, অঙ্গীকার বাস্তবায়নের রূপরেখা ও টার্গেট ঘোষণা করতে হবে। জলবায়ু ও জীবনবান্ধব খাদ্যব্যবস্থার জন্য গ্রামীণ ক্ষুদ্রকৃষক এবং জনগোষ্ঠীনির্ভর অ্যাগ্রোইকোলজিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে সম্মেলনের নবম দিনের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে নগরায়ন, ট্রান্সপোর্ট এবং পর্যটন। সবার জন্য স্বাস্থ্যকর এবং উপযোগী নগর গড়ে তোলা যেমন জরুরি, একইভাবে নগরের নি¤œ আয়ের মানুষদের জলবায়ু ন্যায্যতাকে নিশ্চিত করাও জরুরি। জলবায়ুগত দুর্যোগের কারণে গ্রাম থেকে উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল ঢুকছে নগরে। একটা নগর এত মানুষের ভার সহ্য করতে পারবে না। তাহল নগর ও গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সমন্বিত হতে হবে। গ্রামে মানুষের কাজ, জীবনজীবিকা নিশ্চিত করতে হবে এবং সেখানকার জলবায়ু আঘাতগুলোকে সামাল দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, নগরের নদী, খাল, মাঠ, উদ্যান, পার্ক, বিনোদনকেন্দ্র ও সবুজবলয় সবার জন্য উন্মুক্ত ও নিরাপদ করতে হবে। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিমালায় জলবায়ুগত সঙ্কট, অভিযোজন ও রেজিলিয়েন্সকে যুক্ত করতে হবে। ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকেও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ধীরে ধীরে জনবাবন্ধব ও পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলা জরুরি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশেই পর্যটন আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনজীবিকা এবং বাস্তুতন্ত্রবান্ধব হিসেবে গড়ে ওঠেনি। পর্যটনের নামে যেকোনো এলাকায় প্লাস্টিক ও শব্দদূষণে ঘটে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশ এবং স্থানীয় সংস্কৃতিবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা জরুরি। কোনো এলাকার জলাভূমি, বনভূমি, কৃষিজমি কিংবা বাস্ততন্ত্রের ক্ষতি না করে পর্যটনব্যবস্থাকে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বহু প্রতœতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা নষ্ট হচ্ছে। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির, পাহাড়পুর বিহার কিংবা মহাস্থানগড়সহ বহু প্রাচীন নিদর্শন ও স্থাপনা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বহু স্থাপনা জলবায়ু দুর্যোগের কারণে বিনষ্ট হচ্ছে। লবণাক্ততা এবং ঘূর্ণিঝড়ের সুন্দরবন এলাকার বহু স্থাপনা বিনষ্ট হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ-ফেনী-শেরপুরের বহু স্মৃতিস্মারক নষ্ট হয়েছে। এসব ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার জন্য জলবায়ু অর্থায়ন থেকে বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা সবকিছুই নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে জলবায়ু সম্মেলনে আসা বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, কপ২৯ এ বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জাতীয় প্রতিনিধি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেল প্রস্তাব করেছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই মডেলটি একটি টেকসই এবং সামাজিক ব্যবসায়িক ভিত্তির ওপর ভিত্তি করে এবং বাংলাদেশের নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে, যা একটি গৌরবময় অর্জন। বাংলাদেশ জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলেছে। আমরা উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছি যাতে তারা জলবায়ু অর্থায়ন বাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দেয়। এতে, অভিযোজন এবং প্রশমন প্রচেষ্টায় কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা হবে এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলো জলবায়ু তহবিলের অ্যাক্সেস পাবে, যা আমাদের অভিযোজন সক্ষমতা আরো শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ২২ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) অঙ্গীকার করেছে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) পক্ষ থেকে বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের নতুন দাবি তোলা হয়েছে। এই অর্থায়ন আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।


আরো সংবাদ



premium cement