২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ মাঘ ১৪৩১, ২৮ রজব ১৪৪৬
`
বৈষম্যবিরোধী বীরত্বগাথা

সব সময়ই বাবার কথা বলে কাঁদে শিশু রাতুল ও সিদ্দিক

-

দরিদ্র পরিবারের সন্তান আলী হোসেন দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে পড়ালেখা বেশিদূর এগোয়নি। বাবার যেটুকু সম্পত্তি ছিল তাও পদ্মার ভাঙনে অনেক আগেই শেষ যায়। ফলে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ‘নিউ সুপার মার্কেট দক্ষিণ’ কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলায় ‘সাদা কালো ফ্যাশন হাউজ’ নামের এক দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন আলী হোসেন (৪০)। গুলিটি বুকের ডানপাশে এসে লাগে। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত ১১টার দিকে মারা যান তিনি। ৭ ভাইবোনের মধ্যে আলী হোসেন ছিলেন সবার ছোট। বাবা মো: ইদ্রিস মারা গেছেন অনেক আগেই। তখন আলী ছিলেন একেবারেই ছোট। মা রংমালা (৬০) জীবিত থাকলেও অনেকটাই অসুস্থ। ছোট সন্তানের মৃত্যুর পর একেবারেই ভেঙে পড়েছেন।
২০০৯ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার রতœা আক্তারকে (৪০) বিয়ে করেন। এরপর দুই ছেলে সিয়াম হোসেন রাতুল (১৩), সিদ্দিক হোসেন (৬) ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই কাটছিল আলীর জীবন। তার এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না পরিবার। দুই শিশু সন্তানকে এখন কে দেখবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, এমন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে আলীর স্ত্রী ও বৃদ্ধ মায়ের।
স্ত্রী রতœা আক্তার বলেন, এত ছোট বয়সে ছেলেরা তাদের বাবাকে হারিয়েছে। আমিও কোনো চাকরি করি না। এখন ছেলে দু’টোর কী হবে? ওদের কিভাবে পড়ালেখা শেখাব? ছোট ছেলেটার চোখের সমস্যা, ওকে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হয়। আমি সেই খরচের টাকা পাবো কোথায়?
তিনি বলেন, গত ১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ওদের বাবা বাসা থেকে বের হন দোকানে যাওয়ার জন্য। দোকানে পৌঁছে একবার আমাকে ফোন করে। পরে দুপুরেও একবার কথা হয়। সর্বশেষ আমার সাথে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কথা হয়। আমি তাকে বলি চারদিকে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, সাবধানে বাসায় এসো। সে বলে সমস্যা নেই। আমরা সবাই দোকনে আছি, কোনো সমস্যা হবে না। ভিডিও কলে দোকানের সবাইকে দেখান। এরপর দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময় নিউ মার্কেট এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আলী।

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ভাড়া বাসায় আলী হোসেন। বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জাজিরা গ্রামে। নদী ভাঙনের পর থেকে পরিবারের সবাই রাজধানীর কামরাঙ্গীচর এলাকার চিনিবাড়ি এলাকায় বাস করতেন। তার এমন মৃত্যুতে পুরো পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার।
বড় ভাই আলী আকবর বলেন, ১৯ জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় আমার ভাই। সন্ধ্যায় আমরা খবর পেয়ে ঢাকা মেডিক্যালে যাই। একটা গুলি আমার ভাইয়ের বুকের ডান পাশে লাগে। সেদিন নিউমার্কেট এলাকায় অনেক গোলাগুলি হয়। বাবা অনেক আগে মারা গেছেন, মায়ের বয়স হয়েছে। এখন ছোট ছেলেকে হারিয়ে একদম ভেঙে পড়েছেন। আমরা সব ভাইবোন কামরাঙ্গীরচরে পাশাপাশি থাকি। ওর সন্তানরা বাবাকে হারিয়ে অসহায় জীবন-যাপন করছে। বড় ছেলেটি মাদরাসায় পড়ত। বাবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে নিয়ে এসেছি। সন্তানরা সব সময় বাবার কথা বলতে থাকে, বাবার জন্য কাঁদে।
আলী আকবর আরো বলেন, বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান। তখন আলী হোসেন অনেক ছোট ছিল, কিছুই বুঝতো না। বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই ভাইটিকে মানুষ করি। আমাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। ভাই যেদিন মারা যায় সেদিন সকাল নয়টার সময় আমার সাথে কথা হয়। সে তখন কাজে বের হয়। আমি ওকে বলি, ভাই যাই করো না কেন চারদিকের অবস্থা বেশি ভালো না, সোজা দোকানে গিয়ে আবার সোজা বাসায় চলে এসো। আমিও মার্কেটে চাকরি করি। ও চলে আসার এক-দেড় ঘণ্টা পর আমিও মার্কেটে যাই। আবার দোকান বন্ধ করে দুপুরের দিকে বাসায় চলে আসি। মার্কেটে থাকতে ঘটনার আগেও আমাদের সাথে যোগাযোগ হয়। নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেট থেকে বের হতে চেয়েছিল আলী। ওর সাথে আরেকটি লোকও মারা যায় গুলিতে। তিনি বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়েছে। সন্তানদের নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তা করতে থাকে। আলীর মৃত্যুতে হতাশ হয়ে পড়েছে তার স্ত্রী। সন্তানদের নিয়ে বেশি চিন্তা করছে।
স্ত্রী রতœা আক্তার বলেন, লাশ নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল। মৃত্যুর তিনদিন পর অনেক জায়গা দৌড়িয়ে, অনেক ভোগান্তি পেরিয়ে স্বামীর লাশ বুঝে পাই। পরে ২২ জুলাই আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনিই পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। তিনি বলেন, সরকারের প্রতি অনুরোধ, আমার স্বামী যে শহীদ হয়েছে তার মর্যাদা চাই। ছেলে দুইটারে নিয়ে যাতে কোনোরকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি সরকার যেন তার ব্যবস্থা করে দেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement