দুদকে হাজির না হয়ে সময় চেয়েছেন বেবিচক প্রকৌশলী
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩০
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রভাবশালী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ডাকে হাজির না হয়ে সময় চেয়ে আবেদন করছেন। গত রোববার ছিল তার হাজির হওয়ার দিন। মেগা প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। অনুসন্ধান কর্মকর্তা কমিশনের উপপরিচালক নাজমুল হাসান জানান, গত রোববার ছিল তার হাজির হওয়ার নির্ধারিত তারিখ। তিনি হাজির না হয়ে সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। আমরা পুনরায় তাকে নোটিশ করব। তার কাছে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে সেগুলো সংগ্রহের জন্য তিনি সময় চেয়েছেন। এর আগে বেবিচকের পিএন্ডডি কিউএম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়ে দুদকের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি লিখেছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। চিঠির জবাবে তার পদোন্নতির বিষয়ে আপত্তি দিয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন জানান, তার বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
দুদক থেকে পাওয়া হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগ মতে, বেবিচকে যত মেগা প্রকল্প রয়েছে, প্রায় সবই অর্থ-বাণিজ্য করেছেন তিনি। অনিয়ম হালাল করতে তিনি রাতারাতি টেন্ডারের নিয়ম পাল্টে ফেলেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিনা টেন্ডারে ১৬ কোটি টাকার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজে পিডি থাকার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। পরে তাকে পিডির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সিভিল সার্কেল-১ এর দায়িত্বে থাকাকালে দুর্নীতি ও খামখেয়ালিপনার প্রমাণ পাওয়ায় হাবিবুর রহমানকে বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব না দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে অদৃশ্য কারণে তাকে একের পর এক মেগা প্রকল্পে পিডির দায়িত্ব দেয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে খুলনার খানজাহান আলী বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ ও নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ এবং প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান টার্মিনাল সম্প্র্রসারণ-নবরূপায়ণ এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজ। এসব প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ‘পার্সেন্টেজ’ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, বেবিচক সদর দপ্তর ভবন নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ছিলেন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। বিভিন্ন কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে তিনি অহেতুক বিলম্ব করতেন। ঠিকাদারের সাথে দেন-দরবারের মাধ্যমে ‘পার্সেন্টেজ’ আদায় করে তারপর সিদ্ধান্ত দিতেন তিনি। ফলে ২৪ মাস মেয়াদের কাজ শেষ হয়নি ৭২ মাসেও। তার দুর্নীতির কারণে ভবনের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভবনের জন্য ফার্নিচার ক্রয়ের কাজও বিলম্বিত হচ্ছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের উন্নয়ন কাজ করার সময় সরকারের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অমান্য করেন তিনি। মেনে চলেননি সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের কোনো ধারা। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজে করোনার অজুহাত দেখিয়ে দরদাতার দাখিলকৃত দলিলপত্র সঠিক কি না, সেটা যাচাই-বাছাই না করেই দরপত্র চূড়ান্ত করেন হাবিবুর রহমান। ঠিকাদারের টার্নওভার সংক্রান্ত ব্যাংক নথি যাচাই করেননি। টেন্ডার ডকুমেন্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, অভিজ্ঞতা সনদ, টেন্ডারারস কান্ট্রি অব অরিজিনে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস কর্তৃক ‘অথেনটিকেট’ করে নিয়ে দরপত্র দাখিল করার কথা। কিন্তু ওই ঠিকাদার বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো দলিলপত্র দেননি।
গড় বার্ষিক কনস্ট্রাকশন টার্নওভার সংক্রান্ত শর্ত নিয়েও অনিয়ম করেছেন। এর পরও শর্তপূরণ না করা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন হাবিবুর। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পে ৮টি দরপত্র দাখিল হয়। সেখানে ৩টি প্রতিষ্ঠান সব নথি যথাযথ দাখিল করলেও তাদের মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে বাকি দু’টিকে নন-রেসপন্সিভ করা হয়। যে কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করা হয়েছে তার জয়েন্ট ভেঞ্চারেও রয়েছে অনিয়ম। ওই জয়েন্ট ভেঞ্চারের একটি কোম্পানিকে ২০১৯ সালে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিষয়টি নিয়ে হাবিবুর রহমানকে অন্য ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তার পছন্দের ওই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। পরে আইএমইডির ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিভিশন তদন্তে অনিয়ম এবং জালিয়াতির সত্যতা মেলে। আইএমইডির প্রতিবেদন দাখিলের পর বিষয়টি সেখানেই থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু হাবিবুর রহমান চতুরতার সাথে ঊর্ধŸতন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে আইএমইডির প্রতিবেদনকে পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে টেন্ডার অনুমোদনের জন্য পাঠান মন্ত্রিপরিষদ-সংক্রান্ত ক্রয় কমিটিতে। ক্রয় কমিটির সভায় অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ায় ওই দরপত্র বাতিল করে নতুনভাবে দরপত্র করার নির্দেশ দেয়া হয়।
শুধু কক্সবাজারেই নয়, সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর প্রকল্পে দু’টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ করা হয়। তার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার নথিতে ভুল থাকার পরও রেসপন্সিভ করা হয়। বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়ে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছেন প্রকৌশলী হাবিব। যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজেও ধরা পড়েছে হাবিবুরের নজিরবিহীন দুর্নীতি। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রকল্প কেটে তিন ভাগ করেন। শুধু তাই নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিলেও দু’টি বিমানবন্দর প্রকল্পের কাজ করছে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় থমকে যায় যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজও।
এভাবে বিভিন্ন কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন হাবিবুর রহমান। তিনি গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে বিপুল সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। ঢাকায় বাড়ি ও প্লট কিনেছেন। নামে-বেনামে ব্যাংকে রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ টাকা।
এ ছাড়া তার স্ত্রীও একজন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। স্বামীর অনিয়ম দুর্নীতির অর্থ তার কাছেও গচ্ছিত রয়েছে বলে দুদকের অভিযোগ বলা হয়।
দুদকের তদন্তের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা