নেত্রকোনায় এক টুকরা মেঘালয়
- ফজলুল হক রোমান নেত্রকোনা
- ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৯
ভেসে বেড়ানো মেঘমালা, সারি সারি পাহাড়, জীববৈচিত্র্য আর ঝরনার রাজ্য মেঘালয়। গারো পাহাড়ের গা ঘেঁষে মেঘের ওড়াউড়ি, নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলি, স্থানে স্থানে বয়ে চলা ঝরনাধারা আর চারদিকে নীলাভ মুক্ত আকাশের বিশুদ্ধ বাতাসে এক নিঃশ্বাসে মুহূর্তে পথের সব ক্লান্তি কখন যে দূর হয়ে যাবে বোঝাই যাবে না। ঋতু পরিবর্তনে একেক সময় একেক রূপের কারণে এর সৌন্দর্য ও আকর্ষণে যে কেউ সহজেই বিমুগ্ধ হয়ে যেতে পারেন। গারো পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা রহস্যে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেন অনেকে। শীত, বসন্তে শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে যেমন পর্যকটরা প্রশান্তি লাভ করেন, তেমনি বর্ষায় মেঘের গর্জন ও পাহাড়ি ঢলের ভয়াবহতায় শিউরে উঠার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের একটা স্থান পাঁচগাঁও। দু’চোখ জুড়ানো অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা এই স্থানটি যেন নেত্রকোনায় লুক্কায়িত এক টুকরো মেঘালয়। ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই, ভারতে না গিয়েও কলমাকান্দা সীমান্ত এলাকায় যে কেউ সহজেই মেঘালয় রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। সবুজ উপত্যকা প্রসারিত মালভূমি ও উচ্চভূমি নিয়ে গঠিত একটি পার্বত্য রাজ্য। রাজ্যের কেন্দ্রীয় অংশে রয়েছে খাসী পর্বতমালা, পূর্ব অংশে রয়েছে জয়ন্তীয়া পর্বতমালা এবং পশ্চিম অংশে গারো পর্বতমালা। সর্বোচ্চ চূড়া হলো শিলং চূড়া। যার উচ্চতা ১৯৬১ মিটার। এখান থেকেই প্রাকৃতিক জলপ্রপাতের সূচনা হয়েছে। মেঘালয়ের উত্তর-পূর্বে আসাম রাজ্য। যার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের অবস্থান। আর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে নেত্রকোনার অবস্থান। পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে মেঘালয় রাজ্যের। ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর অন্যতম মেঘালয়। এর আয়তন ২২.৪২৯ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ২৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৯ জন। মেঘালয় শব্দের অর্থ হলো মেঘের আবাস বা বাসস্থান। পূর্বে মেঘালয় খাস, গারো এবং জয়ন্তীয়া উপজাতিদের নিজস্ব রাজ্য ছিল। ১৯ শতকের দিকে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায় এবং ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত আসামের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতাকালে আসামের দু’টি জেলা হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। আসাম রাজ্যের মধ্যে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৬০ থেকে মেঘালয়ের অধিবাসীরা পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে ১৯৬৯ সালে মেঘালয়কে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যে পরিণত করা হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। মেঘালয়ের রাজধানী সিলং। রাজধানীর দক্ষিণে খাসী পাহাড়ের চেরাপুঞ্জিতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে। আর এই গারো পাহাড়ের পাদদেশে কলমাকান্দার সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী গণেশ^রী, মহেশ^রী ও মহাদেও নদী। নয়নাভিরাম, কোলাহলমুক্ত সৌন্দর্যের হাতছানি দেয়া এই স্থানটি আজও অনেকের কাছে অজানা।
এখন আসা যাক, গারো, হাজং উপজাতিদের এলাকা এই মেঘালয়ের কোলে কিভাবে যাবেন। ঢাকা থেকে ট্রেন, বাস, রিজার্ভ গাড়ি, কিংবা মোটরবাইকে যাওয়া যায়। ট্রেনের যাত্রীদের সীমান্তের পাঁচগাঁও যাওয়ার জন্য নেত্রকোনা রেল স্টেশনে নামতে হবে। রিকশা, কিংবা ইজিবাইক দিয়ে দুই কিলোমিটারের পথ রাজুর বাজার নামক স্থানে নামার পর পাঁচগাঁওমুখী বাস, সিএনজি ও মোটরবাইক পাওয়া যাবে। যদি কেউ কলমাকান্দা সদরে নামেন সেখান থেকে আরো ১২ কিলোমিটার দূরত্বে পাঁচগাঁও যেতে হবে। আর ময়মনসিংহ থেকে যেতে চাইলে পাটগুদাম মোড়ে মিলবে বাস, সিএনজি।
পাঁচগাঁও সীমান্তে পৌঁছার পর দৃষ্টির সীমানায় ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকবে মনজুড়ানো সুউচ্চ নীলাভ গারো পাহাড়। উত্তর সীমান্তে যতই এগোতে থাকবেন মনে হবে অপেক্ষমাণ পাহাড় আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। মুহূর্তে পথের সব ক্লান্তি দূর হয়ে প্রশান্তি নেমে আসবে। দু’টি স্পটের মধ্যে বিশেষ করে চন্দ্রডিঙ্গা উল্লেখযোগ্য। গারো পাহাড় যেন বিশাল দেয়াল হয়ে দুই দেশকে যেন পৃথক করে রেখেছে। জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করে পাহাড়ের বুক চিরে ছড়ার মাঝ দিয়ে সারি সারি দানব আকৃতির পাথর ডিঙিয়ে মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের অভ্যন্তরে দেখা মিলবে ঝরনাধারা। যতই এগুনো যাবে ততই বিস্ময়, অজানা শঙ্কা ও বিপদসঙ্কুলে শিহরিত হয়ে উঠবেন। তবে অসতর্ক হলেই সর্বনাশ, যেকোনো মুহূর্তে বিপদ নেমে আসতে পারে। বেশি ভেতরে গেলে বিএসএফের তাড়া খাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া একই উপজেলার পাশের রংছাতি ইউনিয়নের কালিকাপুর ছায়াশীতল জিরো পয়েন্টে রয়েছে সাত শহীদের মাজার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের এই কবরস্থানকেই সাত শহীদের মাজার বলা হয়। পাশ দিয়ে বয়ে চলা গণেশ^রী নদীর ওপারে পাহাড়ের ওপর স্থাপিত বিএসএফ ক্যাম্প দেখতে পাওয়া যাবে। এখানে কোনো অবস্থায় সীমানা অতিক্রম করা যাবে না। সাত শহীদের মাজারের কিছু আগে কালিকা বাজার সংলগ্ন সুউচ্চ যে টিলা রয়েছে সেখানে না উঠলে ভ্রমণ অসমাপ্তই থেকে যাবে। সেখান থেকে দেখা যাবে ইউটার্ন নদী ও দিগন্ত প্রসারিত ভারতীয় সীমানার এক মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য। ব্যস্ততা ও একঘেয়েমি দূর করতে এই স্থানটি পর্যটকদের আদর্শস্থানে পরিণত হয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা