চট্টগ্রামের বেইস টেক্সটাইলজুড়ে লুটপাটের ক্ষতচিহ্ন : ২ জন গ্রেফতার
- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৯
চট্টগ্রামের বাহির সিগন্যালস্থ বিসিক শিল্প এলাকার এক সময়ের নামকরা তৈরী পোশাক ও টেক্সটাইল মিল বেইস টেক্সটাইলের বন্ধ কারখানা থেকে শত কোটি টাকার মালামাল ‘চুরির’ অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলায় দুইজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু একটি শিল্প এলাকার কারখানা থেকে সব মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। পুরো ঘটনাটি এক দিকে যেমনি রহস্যময়, তেমনি দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নতুন বিনিয়োগকে থমকে দিতে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এক সময়ের কর্মচঞ্চল এই কারখানার ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে শুধুই লুটপাটের ক্ষতচিহ্ন। মূল্যবান সব মেশিনারিজ খুলে বা উপড়ে নেয়ার ক্ষত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র খুলে নেয়া, আবার কয়েকটি স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চিহ্ন। ফ্লোরের মসৃণতা নেই। কাচগুলো সব ভাঙ্গা এবং সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অনেকটা কিছু খোলস যেন সেখানে অবশিষ্ট রয়েছে। এসব দেখলে রীতিমতো তাজ্জব বনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিই হবে যে কারো। যা দেখে একজন বিনিয়োগকারী ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকে শঙ্কা থেকেই সঙ্কুচিত করবেন নিশ্চিত ভাবেই। কিন্তু এই লুটপাট যেন এখনো থামবার নয়। অবস্থা এমন যেন কারো কোনো দায় নেই।
খোঁজ নিয়ে গেছে, গত ৬ নভেম্বর ওই কারখানা থেকে আনুমানিক শত কোটি টাকার মালালাম ‘চুরি’র অভিযোগে মামলাটি করেন মীর মানজির আহসান। মামলার এজাহারে কারখানার বিদেশী যন্ত্রপাতি, গ্যাস জেনারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চুরির অভিযোগ করা হয়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কারখানাটির রফতানি কমতে থাকে। একপর্যায়ে ২০২২ সালের জুন মাসে সুইং ইউনিটটি বন্ধ করে দেয়া হয় কিন্তু টেক্সটাইল ইউনিটটি চালু ছিল। পরে ‘শ্রমিক নেতাদের সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষ ও আর্থিক অসঙ্গতির কারণে’ টেক্সটাইল ইউনিটও মালিকপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পরও কারখানার কমার্শিয়াল অফিস চালু ছিল এবং চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত ছিল। পরে কমার্শিয়াল অফিসও বন্ধ করা হলে কারখানার নিরাপত্তা নজরদারি শিথিল হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, চক্রটি কারখানার মূল্যবান সব বিদেশী ডাইং ও ফিনিশিং যন্ত্রপাতি, গ্যাস জেনারেটর, ল্যাবরেটরি মেশিনারিজ, কারখানার অভ্যন্তরে লাগানো এসিসহ মূল্যবান সব মালামাল লুট করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কমপ্লায়েন্স অনুসারে এক সময়ে দেশের শীর্ষ এই তৈরী পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানাটির অভ্যন্তরে এখন শুধু যেন কঙ্কালটি দাঁড়িয়ে আছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর অস্থিতিশীলতার সুযোগে ছোটখাটো চুরি বাড়তে থাকে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেইস টেক্সটাইল লিমিটেডের পক্ষে চান্দগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। কারখানার ব্যবস্থাপক ফয়েজ আহমদ তাতে উল্লেখ করেন, কারখানার সামনে বখাটেদের আনাগোনা বেড়েছে। অজ্ঞাতনামা কিছু যুবক কারখানার নিরাপত্তাকর্মী জহিরুল ইসলামকে অতর্কিতে মারধর করে ও মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যায় বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, কারখানার সর্বশেষ অফিসটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গত মে মাস হতে মাঝে মাঝেই চোরের উৎপাত লক্ষ করা গেছে। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকে কয়েক দিন ধরে বড় ধরনের লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। ট্রাক নিয়ে এসে কারখানার মূল্যবান সব মেশিনারিজ ও এয়ারকুলার সিস্টেম খুলে নেয়া হয়। কারখানা সংশ্লিষ্টরা পুলিশে খবর দিলে পুলিশ আসার খবরও তাদের কাছে পৌঁছে যেত এবং তারা দ্রুত সটকে পড়ত। পরে পুলিশ চলে গেলেই আবার শুরু হতো লুটপাট। বন্ধ কারখানায় বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের মারধর করে মালামাল লুট করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়। সূত্র জানায়, যেসব মূল্যবান মেশিনারিজ লুট করা হয়েছে সেগুলো পেশাদার লোকেরাই অন্যত্র স্থাপন উপযোগী করেই খুলে নিয়েছে। সামান্য কিছু মেশিনারিজ লোহার টুকরা হিসেবে বিক্রয়যোগ্য করে নেয়া হয়েছে বলেও সূত্র জানায়। স্থানীয় একটি সূত্র দাবি করেছে ব্যাপক এই লুটপাটচক্রের পেছনে বড় কারো হাত থাকতে পারে, নইলে শত কোটি টাকার মালামাল নির্বিঘেœ লুট করার সাহস পেত না চক্রটি।
সংশ্লিষ্টদের দাবি বেইস টেক্সটাইল কারখানার অভ্যন্তরের সিসিটিভি লুটেরারা আগেই সরিয়ে নিয়েছে। ফলে আশপাশের কারখানাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সহজেই অন্তত একমাসের লুটপাটের চিত্র পাওয়া সম্ভব। এতে ঘটনার কিছুটা হলেও কূলকিনারা হতো বলে মালিক পক্ষের দাবি।
এ দিকে ৬ নভেম্বর মামলা হওয়ার পরও কারখানাটি একেবারেই অনিরাপদ বলে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে। এখনো ‘চোর’রূপী লুটেরারা কারখানাটিতে হানা দিচ্ছে, গ্যাস লাইন ও ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রের পাইপগুলোও এখন কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: আফতাব উদ্দিন গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, শত কোটি টাকার মালামাল চুরির অভিযোগে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা দুইজনকে গ্রেফতার করেছি। মামলার তদন্ত চলছে বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি জানান, ৫ আগস্টের পর পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগ কেউ নিতে পারে, তবে এর আগে থেকেও কারখানাটিতে চুরির ঘটনা ঘটে আসছিল। কারখানার মালিকপক্ষের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় জানিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে দিনে তিন-চারবার কারখানা এলাকায় টহল দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
বেইস টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: হাসান শিবলী বলেন, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কারখানায় ট্রাক নিয়ে এসে মালামাল নিয়ে গেছে দুষ্কৃতকারীরা। পুলিশ তদন্ত করলে আশপাশের কারখানার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের প্রত্যাশা, পুলিশ চাইলে এখনো কারখানার চুরি হওয়া যন্ত্রপাতি উদ্ধার করতে পারে। তিনি বলেন, একটি শিল্প শুধু ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আমার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমার এই বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাষ্ট্রের কি এই প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কোনো দায়িত্ব নাই? এত বড় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসকারী সন্ত্রাসীদের কি শনাক্ত করা হবে না?
১৯৯৬ সালে চালু হওয়া এই কারখানাটির চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে দেশের শীর্ষ তৈরী পোশাক রফতানিকারকদের মধ্যে অন্যতম ছিল।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা