১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
সিপিডির জরিপ তথ্য

দুর্নীতি বাংলাদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা

ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডির ডায়লগ অনুষ্ঠানে অতিথিরা : নয়া দিগন্ত -

- মুদ্রাস্ফীতি, মন্দা ও দারিদ্র্যবৈষম্য ৩ ঝুঁকিতে দেশ : ড. গোলাম মোয়াজ্জেম
- রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হলো সব সমস্যার মূল : আবদুল আউয়াল মিন্টু
- দুর্নীতিই ব্যবসা প্রসারে আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা : বিটিএমইএ

মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য আগামী দু’বছরের জন্য অর্থনীতির এই তিনটি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ওই তিন ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশে চরম অনিশ্চয়তা রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিকে তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই হলো সব সমস্যার মূল। এসবের কারণেই বাংলাদেশের ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংস্কার রাজনীতিতেও আনতে হবে।

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার অডিটোরিয়ামে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ সংস্কার : অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডা’ শীর্ষক একটি সংলাপে ব্যবসায়ী নেতারা ও গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব কথা বলেন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার (উপদেষ্টা) আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আলোচনায় অংশ নেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু, এফআইসিসিআইয়ের সভাপতি জাভেদ আখতার, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ডিসিসিআইর সভাপতি আশরাফ আহমেদ ও বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুনে পরিচালিত এ জরিপে আরো বেশ কয়েকটি সমস্যা উঠে এসেছে। সেগুলো হলো- অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, দুর্বল জনস্বাস্থ্য, অপরাধ ও চুরি এবং শ্রমবাজারে নৈতিকতার অভাব।

উপস্থাপনায় ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে ডুয়িং ব্যবসা করার জন্য ১৭টি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, নীতির অস্থিতিশীলতা, দুর্বল শ্রমশক্তি, শিক্ষিত শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা, উচ্চ কর হার, ট্যাক্স প্রবিধানের জটিলতা, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরাধ এবং চুরি, উদ্ভাবনের জন্য অপর্যাপ্ত ক্ষমতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঝুঁকিপূর্ণ জনস্বাস্থ্য এবং শ্রমনীতির সীমাবদ্ধতা। তিনি বলেন, আমরা মনে করি দুর্নীতি সর্বদাই প্রধান সমস্যা। যদিও অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সমস্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, তিন ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি আলোচ্য সময়ে তিন ধরনের সামাজিক ঝুঁকিও রয়েছে। যেগুলো হলো- বেকারত্ব, জ্বালানি ঘাটতি এবং হৃদরোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস রোগের প্রাদুর্ভাব অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়।

উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, ব্যবসা পরিচালনায় ঘুষের কারবার আরো বেড়েছে দেশে। ৫৭ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী মনে করেন, কর সংক্রান্ত সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়। আগের বছর এ অভিযোগ ছিল ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবসায়ীর। গত সরকারের সময় ব্যবসা পরিবেশে লক্ষণীয় উন্নতি হয়নি। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য কুক্ষিগত ছিল। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা ছিল।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বছরের পর বছর ধরে অদক্ষ আমলাতন্ত্র আর একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে। মুদ্রাস্ফীতি সব সময় বড় চিন্তার কারণ। অন্যদিকে নীতির অস্থিতিশীলতা একটি মাঝারি স্তরের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার মানদণ্ডে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা ও ভারতের চেয়ে পিছিয়ে। অর্থনীতির তুলনায় ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। তাই আর্থিক খাতেও ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, প্রয়োজনে বিজনেস রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন গঠন করা হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা সরকারের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনছি। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
এফবিসিসিসিআই সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই সব সমস্যার মূল। দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতি থেকে কিছুই প্রত্যাশা করতে পারি না। প্রথমেই উচিত রাজনীতিতে সংস্কার আনা। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কার চাওয়া ভুল। তিনি বলেন, সমাজে একটি গ্রুপ ভালো কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে। আরেকটি গ্রুপ দৃর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অর্থ বানাচ্ছে।
ফিকি সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে। তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ যে আনবে, তার তো দেশে ব্যবসার পরিবেশের প্রতি বিশ^াস থাকতে হবে। কারণ এই বিনিয়োগ থেকে সে রিটার্ন পাবে কিনা। আর বিনিয়োগকারী আনাই আসল না, তাদেরকে টেককেয়ারও করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কার্যকর কর হার অনেক বেশি। অথচ বলা হচ্ছে কর হার কমানো হয়েছে। অবকাঠামো যা আছে সেটাকে কার্যকর রাখতে হবে।
ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হলো দুর্নীতি। সেবা দিতে দুনীতি করা হচ্ছে। ব্যবসা- বাণিজ্য বাড়াতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

বিটিএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতি থেকেই মূল সমস্যা শুরু হয়। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে ঘুষের ওপর ঘুষ চলে। বিশেষ করে করের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। এনবিআরকে ভিন্ন ভিন্ন পলিসি দিয়ে দুর্নীতি কমানো সম্ভব। এ বিষয়ে আর একটি প্রোগ্রাম করা যেতে পারে। দুর্নীতি কমানোর জন্য সৎ মানুষ থাকলেই হবে না। সততার পাশাপাশি ইতিবাচক মানসিকতা জরুরি। তিনি বলেন, ডিজিটাল করসহ এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাটসহ সব বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক পলিসি নিতে পারলে দুর্নীতি অর্ধেক কমে আসবে।
সংলাপে ব্যবসায়ীরা বলেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, দুর্নীতি, প্রবৃদ্ধির হিসাবে গরমিলের কারণে অর্থনীতিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হচ্ছে। একই সাথে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতির বড় অনিশ্চয়তা এখন উৎপাদন খাতে। নানা রকম উদ্যোগের পরও সবচেয়ে বড় রফতানি শিল্প পোশাক খাতে উৎপাদনব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর রয়ে গেছে। জুলাই মাস থেকে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের পোশাকশিল্প এলাকা শ্রমিক বিক্ষোভ দেখছে। সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও তা টেকসই হয়েছে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement